১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। ভোক্তাদের অধিকার ও স্বার্থ সমুন্নত রাখার জন্য অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও দিবসটি নানা আয়োজনের মাধ্যমে পালিত হয়। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন নিরাপদ, ভেজালমুক্ত ও পুষ্টিকর খাদ্য। কিন্তু বাংলাদেশে ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাবার প্রাপ্তিই ভোক্তা অধিকারের পথে প্রধান বাধা। বাংলাদেশে বিশুদ্ধ খাবার প্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়েছে।
পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে খাবারে স্বজ্ঞানে স্বেচ্ছায় ভেজাল মেশানোর কোনো ব্যবস্থা আছে কি না, জানি না। আমাদের দেশে এটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কে কত ভেজাল মেশাতে পারে! প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভেজাল মেশানোর পদ্ধতি উদ্ঘাটিত হচ্ছে। মাঝেমধ্যে কিছু কিছু দুষ্ট ব্যবসায়ীকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা এবং বড়জোড় দুই-এক সপ্তাহ করে কারাদণ্ড দিতে দেখা যায়। এর বিপরীতে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না।
আসলে খাদ্যে ভেজাল একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যাটি কেবল নিরাপদ খাবারের জন্য মানুষের অধিকারকে অগ্রাহ্য করছে তা নয়, বরং অসংখ্য জীবনঘাতী ও দীর্ঘস্থায়ী রোগের জন্য জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করছে।
খাদ্য শুধু মানুষের জন্য নয়, বরং সব প্রাণীর শক্তির প্রধান উৎস। খাবারগুলো বিভিন্ন রুটে শরীরে গৃহীত হয়, যা শক্তি আকারে বা টিস্যুগুলো গঠনে পুষ্টি সরবরাহ করে। অন্যদিকে, ভেজাল খাদ্য মানুষের হজম প্রক্রিয়াকে অচল করে তোলে। এমনকি খাদ্যের বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ শিশুদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি লিভার, কিডনি ও হৃদপিণ্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ মানব অঙ্গগুলোর শুধু ক্ষতিই করে না, একই সঙ্গে ক্যানসার, হেপাটাইটিস-বি’র মতো মারাত্মক রোগও সৃষ্টি করে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, এটা কেবল খাদ্যসামগ্রীর ক্ষেত্রে নয়, জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল মেশানো হচ্ছে।
কার্বহাইড্রেড, ফরমালিন, ভারী ধাতু, রাসায়নিক, টেক্সটাইল রং, কৃত্রিম মিষ্টি, ইউরিয়া ইত্যাদি খাদ্যে ভেজালের জন্য প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। বিষাক্ত রাসায়নিকের সঙ্গে খাবারগুলো দূষিত করা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করে, বিশেষত বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে স্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে সচেতনতার স্তর খুব কম এবং এজাতীয় খাবারগুলো গ্রহণের তাৎক্ষণিক প্রভাবে ডায়রিয়ার মতো প্রাণঘাতী মারাত্মক রূপ নিতে পারে।
দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্যের এই রাসায়নিকগুলো লিভার ও কিডনির মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে, যার ফলে অঙ্গহানি বা ক্যানসার তৈরি হয় এবং এভাবে অকালমৃত্যুও হতে পারে। চরম সত্যটি হচ্ছে, সর্বস্তরের মানুষ বিষাক্ত রাসায়নিকের সঙ্গে ভেজালযুক্ত খাবার গ্রহণের বিপদ সম্পর্কে সচেতন ও জ্ঞাত। তবে এই জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ ও অনুশীলন হয় না বললেই চলে। তবে বাংলাদেশে খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার জন্য আইন ও বিধিবিধানের অভাব নেই।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতে, আমাদের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ কিডনি রোগী। এছাড়া দেশে ৪৫ লক্ষাধিক লোক প্রতিনিয়ত ভেজাল ও দূষিত খাবার গ্রহণের মাধ্যমে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী প্রতিনিয়ত ৬৬ কোটির বেশি মানুষ ভেজাল খাবার গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে এবং প্রতিদিন ৪ লক্ষাধিক মানুষ এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে। বেশ কিছু দিন আগে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য ও ভোক্তা অধিকার আন্দোলন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আয়োজিত মানববন্ধনের সময় এই ভয়ংকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল। এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করে এবং মানুষের মধ্যে কীভাবে নৈতিকতা ও নৈতিকতার মান তৈরি করা যায়, সে বিষয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে।
এটির মতো আরো বিভিন্ন সংস্থা খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি এবং ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ফ্রেশ ফুড ফর অল (এফএফএ), কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) মতো অলাভজনক সংস্থাগুলো এর মধ্যে কয়েকটি। খাদ্যে ভেজাল রোধে সরকার বিভিন্ন আইন করেছে। যেমন—ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, নিরাপদ খাদ্য সুরক্ষা আইন, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য এবং এসব আইনে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
তবে নির্ভরযোগ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সমস্যাটি সঠিক এবং যথাযথ প্রয়োগের মধ্যে যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা এমন একটি প্রধান শহর, যেখানে বিভিন্ন ভেজাল ও দূষণকারীদের সবচেয়ে বেশি অংশ বাস করে, বলা যায় দূষণ বা ভেজালকারীদের স্বর্গরাজ্য। এই দূষণ কখনো মানবসৃষ্ট, আবার কখনো শিল্পের নিঃসারণ বা বিষাক্ত পানির মিশ্রণ ইত্যাদি দ্বারা সম্পন্ন হয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ দুর্নীতি দমন কমিশনকে ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ তারিখে দুধ, দই এবং গবাদি পশুর ভেজাল সম্পর্কে তদন্তপূর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিল। আদালতসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল, যাতে ভেজালজাত পণ্য এবং গবাদি পশুর খাদ্যে সিসা, অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক বা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক অন্যান্য উপাদান রয়েছে কি না তা খুঁজে বের করা যায়। আদেশটি এজাতীয় ভেজালের ক্ষেত্রে খুব প্রাসঙ্গিক বিষয় ছিল এবং এটি মূলত মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের ক্ষতির জন্য দায়ী। কিন্তু বিষয়টি কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তা ভোক্তাদের কাছে খুবই অস্পষ্ট ও দুর্লভ।
এই অবস্থায় ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে জনসচেতনতাও খুব জরুরি।