১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা নিয়মিত ফ্যাশনে পরিণত হয়েছিল। গত দেড় দশকে এই বিকৃতি বহুলাংশে দূর করা সম্ভব হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার থাকার কারণে। কিন্তু ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাকে অস্বীকার করার প্রবণতা এখনো রয়ে গেছে। ২০২০ সালে ‘বিশ্বনেতাদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু’ নামে একটি বইয়ে আমি এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ ও দলিল হাজির করেছি। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা হিসেবে রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গী হওয়ার সুবাদে এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার রাষ্ট্রনায়ক ও বিশ্ববরেণ্য নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তারা ১৯৭১ সালে সেসব দেশের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, একাত্তরের খলনায়ক জেনারেল টিক্কা খান নিজেই আমাকে বলেছেন, ‘২৫ মার্চ রাতে রেডিওতে শেখ মুজিবের কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে আমি তাকে গ্রেফতার করি। তিনি পাকিস্তানের পরিবর্তে পাকিস্তানের মধ্যে বাংলাদেশ নামক নতুন আরেকটি দেশের ঘোষণা দেওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা ছাড়া আমার আর কোনো বিকল্প ছিল না।’ তবে এ ব্যাপারে সবচেয়ে দামি কথা বলেছেন তৎকালীন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথ। সেই প্রসঙ্গেই আসছি।
স্যার এডওয়ার্ড হিথ ১৯ জুন ১৯৭০ থেকে ৪ মার্চ ১৯৭৪ পর্যন্ত গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে আমাকে লিখিতভাবে এই মর্মে বিবৃতি দিয়েছেন যে, ‘১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে নতুন দেশের নাম ঘোষণা করেন।’ সে সময় গণতান্ত্রিক বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিশ্ব জুড়ে তার খ্যাতি ও সুনাম ছিল। বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে তিনি বহু ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের প্রসার লাভ ঘটে এবং তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের সামরিক শাসনের অবসান হয়। তদস্থলে গঠিত হয় নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার। এমন দেশের ক্ষেত্রে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্যার এডওয়ার্ড হিথের প্রচ্ছন্ন ও পরোক্ষ আশীর্বাদ ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ স্বীকৃতি দিয়েছেন।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে এক সময় সূর্য অস্ত যেত না বলে ইংরেজদের গর্ব ছিল, ভারতবর্ষ তখন ছিল ইংরেজদের কলোনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ কলোনিগুলো ক্রমশ স্বাধীন হয়ে যায় এবং ভারতবর্ষ ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু ব্রিটিশ কলোনিগুলো স্বাধীন হয়ে গেলেও তাদের সঙ্গে ‘কমনওয়েলথ’ ভিত্তিক নতুন বন্ধন গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে এসব দেশের ওপর গ্রেট ব্রিটেনের অদৃশ্য আধিপত্য প্রচ্ছন্নভাবে বজায় থাকে। কমনওয়েলভুক্ত দেশগুলো সেজন্য গ্রেট ব্রিটেনের ওপর নানাবিধ কারণে নির্ভরশীল বটে। সাবেক ব্রিটিশ কলোনি হিসেবে পাকিস্তানের ওপরও গ্রেট ব্রিটেনের অনুরূপ অদৃশ্য প্রচ্ছন্ন আধিপত্য বজায় ছিল এবং পাকিস্তানও গ্রেট বিটেনের ওপর উল্লিখিত কারণে পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল ছিল। বস্তুত কমনওয়েলভুক্ত দেশগুলোর ওপর ব্রিটেনের কূটনৈতিক আধিপত্য গত শতাব্দী পর্যন্ত বেশ শক্ত এবং প্রায় সিদ্ধান্তমূলক ছিল। এমন এক সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ব্রিটেনের অকুণ্ঠ সমর্থনের ঘটনা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন উপলক্ষ্যে আমি জেনেভায় যাই। সেখানে হোটেল ‘শেরাটন জেনেভায়’ দুপুরের সময় ঢুকতেই দেখি প্রবেশমুখে রিসিপশনের নোটিশ বোর্ড। সেখানে দিনের প্রোগ্রাম অনুযায়ী এক সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথের ভাষণ দেওয়ার কথা। সেখানে গিয়ে দেখি, তিনি তখনো ভাষণ দিচ্ছেন। বক্তৃতা শেষে তিনি মঞ্চ থেকে নেমে আসতেই লোকজনের ভিড় ঠেলে আনন্দের আতিশয্যে তার দিকে হাত বাড়াতেই তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি তাকে দ্রুত আমার পরিচয় দিয়ে বললাম একসেলেন্সি, আমি বাংলাদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা’ তিনি বললেন, ‘তোমাকে স্বাগত জানাই’। তার ভাষায়, ‘I am one of you. I fought for you in diplomatic world. I am a friend of Sheikh Mujib. I am proud to be his friend. খুবই বিনম্র চিত্তে তাকে ভিড়ের মধ্যে জিজ্ঞাসা করলাম :‘আমাদের দেশে খুব মতভেদ আছে, সেজন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ বিষয়ে আপনার একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য আমি উদগ্রীব। কেননা ৭১ সালে গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে আপনি মৌলিক অবদান রেখেছেন স্যার।
এ সময় তিনি ভ্রু কুঁচকে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন : ‘কী বিষয়ে যেন তোমার জাতি বিভক্ত বললে?’ আমি বললাম : ‘একাত্তর সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ আসলে কে ঘোষণা করেছিলেন।’ আমার প্রশ্ন শেষ না করতে দিয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন :‘একটু থামো, থামো প্লিজ, পাকিস্তানের পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে শেখ মুজিব ছাড়া আর কার বৈধ কর্তৃত্ব ছিল স্বাধীনতা ঘোষণা করার?’ তিনি তখন ব্যস্ত ছিলেন। তবে তার প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে এক হিতৈষীর সাহায্যে তিন মাস পরে আমি এক ব্যক্তিগত সফরে লন্ডনে গেলাম। ৩রা এপ্রিল, বুধবার, ১৯৯৬ লন্ডন পৌঁছে স্যার এডওয়ার্ড হিথের অফিসে কল দিলাম। তার সেক্রেটারি অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি বললেন: ‘স্যার এডওয়ার্ড হিথ আপনার জন্য তার প্যাডে একটি বিবৃতি লিখে স্বাক্ষর করে রেখে গেছেন, আপনাকে দেওয়ার জন্য।’ তার এই বিবৃতিটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ‘একটি ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট’। মাত্র তিন প্যারার ১৯২ শব্দের ডকুমেন্টের প্রথম বাক্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুদ্ধ ইতিহাস যথার্থই তুলে ধরে তিনি লিখেছেন : ‘Twenty-five years ago, on 26 March 1971, Sheikh Mujibur Rahman proclaimed the ‘sovereign independent peoples Republic of Bangladesh.’ অর্থাৎ ২৫ বছর পূর্বে ১৯৭১ সালে ২৬শে মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু দ্বিতীয় প্যারার বাক্যের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন :‘…which was not in any way incited or inspired by the Communist bloc.’ এর অর্থ—বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোনোক্রমেই কমিউনিস্টদের দ্বারা অনুপ্রাণিত কোনো যুদ্ধ ছিল না।
তার কাছে কমিউনিস্টদের কোনো বিষয় জানতে চাওয়া হয়নি। তা সত্ত্বেও তিনি কমিউনিস্টদের বিষয়ের অবতারণা কেন করলেন? আসলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্রনায়কদের কাছে কমিউনিস্টদের যুদ্ধ বলে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছিল। পরবর্তীকালে আমি সরাসরি তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। সেখানে তিনি বলেন, ‘একাত্তর সালে লন্ডন ছিল বাংলাদেশের সেকেন্ড ক্যাপিটাল, দ্বিতীয় রাজধানী।’ বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিতে পারা সত্ত্বেও তিনি ও তার সরকার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রেরিত প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে লন্ডনে বাংলাদেশের অফিস খুলতে দিয়ে এবং লন্ডনে হেড অফিস করে সমগ্র ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশের সপক্ষে রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণা চালাতে দিয়েছেন। ব্রিটিশ জনগণ, বিবিসি, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এবং বিশেষ করে, সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথ ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য ও বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ইউরোপ-আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীদের ওপর ব্যাপক প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করে যে মৌলিক অবদান রেখেছেন সে ঋণ বাংলাদেশের জনগণ কোনোদিন শোধ করতে পারবে না।
সেই লিখিত দলিলে তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ‘বাংলাদেশের উক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল একটি ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক যুদ্ধ।…সে সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে কমিউনিস্টরা বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধটা কোনোক্রমেই সে ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল সে দেশের জনগণের গণতান্ত্রিক দাবির একটি দীর্ঘকালের ন্যায় সংগ্রাম এবং গণতান্ত্রিক নীতিমালার অধীনে পরিচালিত একটি গণতান্ত্রিক অধিকারের যুদ্ধ। যার পশ্চাতে ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নির্বাচিত এমপিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী প্রবাসী সরকার লন্ডনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে তদানীন্তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নিয়োগ করেন। ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশকে তখনো প্রকাশ্য স্বীকৃতি না দিলেও লন্ডনে বিচারপতি চৌধুরী রাষ্ট্রদূতের মর্যাদা ও প্রটোকল পেয়ে যান এবং লন্ডনকে কেন্দ্র করে তিনি সমগ্র ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে সমর্থ হন। পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি অফিসাররা তার অধীনে যোগদান করে সেখানে বাংলাদেশের দূতাবাসের ব্যাপক কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন। ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশের এই কার্যক্রম মৌন সমর্থন দিয়েছিল। এই মৌন সমর্থনের পশ্চাতে ছিল স্যার এডওয়ার্ড হিথের সম্মতি। মুজিবনগর থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন স্যার তার ভ্রাম্যমাণ কোনো দূতকে ইউরোপ-আমেরিকার কোথাও পাঠাতে চাইলে প্রথম ভিসা ভারতের ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে পাওয়া যেত। তার ভ্রাম্যমাণ দূত মুজিবনগর থেকে লন্ডন হয়ে বিশ্বের অন্যান্য রাজধানীতে সহজেই চলে যেতে পারতেন। ব্রিটেনের এ সাহায্য তখন বাংলাদেশের জন্য বিশ্বের সিংহদরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছিল।