বাঙালির রসনাবিলাসের শেষ নেই। আধুনিক বাঙালি ঘরে তৈরি খাবারের পাশাপাশি কেনা খাবারেও আসক্ত হয়ে পড়ছে। তাদের চাহিদা মেটাতে গজিয়ে উঠছে নিত্যনতুন খাবারের দোকান। এখন ঘরে বসেই হোটেলের খাবার পাওয়া যায়। জনপ্রিয় হচ্ছে হোম ডেলিভারি সিস্টেম। এ কারণেই কি দেশ জুড়ে এখন একটা চাই-চাই আর খাই-খাই সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে? প্রখ্যাত লেখক শিবরাম চক্রবর্তী তার লেখায় নিজের জীবনের দুটি মাত্র লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন—‘খাই আর শুই’। সাহস করে কিংবা লজ্জা ভেঙে মুখে না বললেও শিবরাম চক্রবর্তীর মতো ‘খাই আর শুই’ লক্ষ্য নিয়ে চলা বাঙালির সংখ্যা নেহাত কম হবে না। আমরা খেতে বসে ‘ভাতঘুম’ দেওয়ার কল্পনায় উদ্বেলিত হই আবার ‘ভাতঘুম’ দিয়ে উঠে কী খেতে পারি সেই ভাবনাও মন থেকে সরে না। ভালো ভালো খাবারের কল্পনায় শিবরাম যেমন বলেছেন, ‘মনে পড়লে এখনও জিভে জল আসে। নিজেকে সজিভ বোধ করি।’ ঠিক তেমনি বাঙালি মাত্রই ‘সজিভ’ বোধ করে ‘সজীব’ থাকতে ভালোবাসে।
‘পেটে খেলে পিঠে সয়’:বাঙালির কাছে খাবার কেবল জৈবিক উদরপূর্তির চাহিদা নয়। আর তাই বাঙালির কাছে বৈদিক সংস্কৃত অনুসারে ‘ভোজন’ শব্দের অর্থে সুখানুভূতি এবং খাদ্য দুটোই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আমাদের খেয়ে সুখ, খাইয়ে সুখ, খাবারের কথা ভেবে সুখ, খাবারের কথা বলে সুখ আবার কে কত বেশি খেতে পারি কিংবা খাওয়াতে পারি তার প্রচ্ছন্ন কিংবা অপ্রছন্ন তুল্যমূল্য বিচারে নেমেও সুখ। ‘ভোজন’-এর আনন্দযাপনে যোগ্যতার বিচারে কেউ আমরা ‘ভোজনবিলাসী’, কেউ ‘ভোজনরসিক’ কিংবা ‘ভোজনপটু’, কেউ আবার ‘ভোজন বিশারদ’। প্রখ্যাত কথাসাহিতিক সৈয়দ মুজতবা আলী কিন্তু এব্যাপারে তার সুস্পষ্ট মতামত জানিয়ে গেছেন। তার মতে, খাদ্যের হাজার রকমফের থাকলেও মোটাদাগে খাদক দুই প্রকার—ভোজনবিলাসী আর ভোজনপটু। ভোজনবিলাসীরা হাজার খাবারের ভিড়েও তাদের মন-মর্জি অনুযায়ী, তাদের রসনার ধার মাথায় রেখে তারিয়ে তারিয়ে খাবার উপভোগ করেন, সব খাবার তাদের রুচিতে সইতে না-ই পারে। অন্যদিকে ভোজনপটুদের খাবারে কোনো বাছবিচার নেই। পেটে জায়গা না থাকলেও তাদের মনের আর চোখের খিদে মরে না কখনো, কোনো অবস্থাতেই। খাবার হলেই হলো, সেটা যে খাবারই হোক না কেন! খাবার হজমে তাদের পটুত্ব অবিসংবাদিত। তো সেই আপনি ভোজনবিলাসীই হন কিংবা ভোজনপটু, বাঙালি মাত্রই ভোজনরসিক, কেউ আবার আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ভোজনবিশারদ। তাই বাঙালির সুখ বা আনন্দ উদযাপনে খাবারদাবারের বেশ এক যোগ আছে, সবাইকে আয়োজন করে খাওয়ানোর চল আছে; আবার গভীর দুঃখের কিংবা শোকের আবহেও বিশেষ খাবার বা বিশেষ করে খাবার ও খাওয়ানোর প্রথা চলে আসছে যুগ থেকে যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, সীমান্তের এপারে-ওপারে, জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে। ‘ভজন’-এর চেয়ে ‘ভোজনেই’ বাঙালির আগ্রহ বেশি বরাবর।
মজার ব্যাপার হলো, ইদানীং বাঙালি খাবারের ক্ষেত্রে ‘হালাল’ খোঁজে। একবার যদি রটিয়ে দেওয়া যায় যে বিড়াল, শেয়াল বা কুকুরের মাংস খাওয়ানো হয়েছে; তাহলে বাঙালি কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দেয়। যদিও বাঙালির জীবনাচরণ, মানসিকতা ও চিন্তাভাবনায় খুব একটা ‘হালাল’ উপাদান দেখা যায় না। বাঙালির ভাষার মধ্যেও রয়েছে খাওয়ার আধিক্য। এখানে সবই ‘খাওয়া’। পানি খায়, ঘুষ খায়, মদ খায়, গাঁজা খায়। এমনকি হুংকার ছাড়ে—খাইছি তোরে!
আমরা বাঙালিরা চা খাই, কফি খাই, শরবত খাই। আর হ্যাঁ, যেটা ভাবছেন, সেই শরাবও খাই। কেবল তরল পদার্থ? বাঙালি সিগারেট খায়, বিড়ি খায়, চুরুট খায়। দুর্বল পেটরোগা মানুষ, যার কোনো কিছু খেলে হজম হয় না, সে-ও কিন্তু ‘গ্যাস খায়’। খাওয়ার কি শেষ আছে? কর্তাব্যক্তিরা সুযোগ পেলে অধস্তনের ‘চাকরি খায়’। বিপদে পড়ে ‘খাবি খায়’। মার খায়।
সর্বভুক হয়তো বলা যাবে না, তবে বাঙালি নিশ্চিতভাবেই বহুভুক, বিচিত্রভুক। বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে খাওয়া-খাওয়ির বিচিত্র ফিরিস্তি। বাঙালির গাড়ি পেট্রোল খায়। ড্রাইভারদের জিগ্যেস করলে তারা বলে দেয়, কোন মডেলের গাড়ি কত তেল খায়।
খাওয়াদাওয়ার বিলাসিতাই যে বাঙালির পতন আর মূর্ছার কারণ—এই সিদ্ধান্ত নানা জন নানাভাবে নিয়েছিলেন। বাঙালি জাতির পতনের কারণ হিসেবে খাওয়াদাওয়ার প্রতি এই দোষারোপ অন্য অনেক কিছুর মতোই উনিশ শতকে শুরু হয়েছিল—যুক্তি সাজানো হয়েছিল ইতিহাস-ভূগোল মেনেই। বিখ্যাত সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র, যিনি নিজেও কিছু কম খাদ্যরসিক ছিলেন না, তিনি বিবিধ প্রবন্ধে বাঙালিদের জানিয়ে দিয়েছিলেন ‘তেজোহানিকর ধান্য’ই উদ্যমী আর্যদের অলস করেছিল, পূর্বাংশে চলে আসা সেই আর্যতান্ত্রিক আলসেমির সন্তানদল আধুনিক বাঙালি নানাভাবে তার মাশুল দিচ্ছে ইংরেজ উপনিবেশ পর্বে ও তার আগে, এই ছিল বঙ্কিমি সিদ্ধান্ত। গৃহসুখপরায়ণ, উদ্যমহীন ভাতখেকো বাঙালির জীবনে পরাধীনতা যেন অনিবার্য। খাওয়াদাওয়া নিয়ে ধর্মীয় বাছবিচারও কালে-কালে কিছু কম নয়। উনিশ শতকেই আবার নতুন করে কী খাবেন আর কী খাবেন না, তার তালিকা নির্মিত হচ্ছে। শুধু ‘বাংলাভাষাজ্ঞানী’ ঈশ্বর গুপ্ত তো পাঁঠা, আন্ডাওয়ালা তপসে মাছ, আনারস—সবকিছু নিয়েই কাব্য করেন, হোটেলের চপ-কাটলেটও বাদ যায় না। উদরপূর্তিতে গুপ্ত কবির তেমন বাছবিচার নেই। স্বদেশের মানুষকে শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অবশ্য সবকিছু খাওয়া চলবে না—স্বাস্থ্যকর, সহজপাচ্য, বলবর্ধক বস্তু খাওয়া চাই। বিবেকানন্দের ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ এই খাবেন-খাবেন না’র সরস তালিকা প্রদান করেছে।
শুধু খেলেই তো হবে না। কীভাবে খাবেন, কোন পাত্রে খাবেন, কীভাবে পরিবেশন করবেন—তা-ও জানা চাই। এমনিতে বাঙালির শরীরে ছত্রিশ জাতের রক্ত মিলেমিশে গেছে। রান্নার রকমসকম তাই এক নয়। গ্রাম-শহর, হিন্দু-মুসলমান, পাহাড়ি-সমতল, উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গ, শাক্ত-বৈষ্ণব—কত যে ভেদ-বিভেদ। নানা গোষ্ঠীর নানা রান্না, নানা বাসন, নানা আসন। বিলেতি, দেশি কত ঘাটের জল খেয়ে বাঙালির বেঁচে থাকা। সব মিলিয়ে খাওয়াদাওয়ার জগৎ মোটেই অন্দর থেকে সিংহদুয়ার অবধি মাত্র নয়, সে এক বিস্তৃত পরিসর। আর খাওয়া তো শুধু বাইরের জিনিস নয়, মনেরও জিনিস। খাওয়ার বর্ণনায় যে পাত্রপাত্রীর মনের টানাপোড়েন ধরা পড়ে, তা কে না জানে। ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে বিমলা যে সন্দীপকে হঠাৎ খাওয়াতে চাইল আর সন্দীপও যে বিশেষ হামলে পড়ে খেল, সে কি আর এমনি-এমনি!
খাবার নিয়ে তো অনেক ঘটনাই লক্ষ করা যায়। বিয়েবাড়িতে খাবার কম পড়লে মারামারি-খুনোখুনির ঘটনা প্রায়ই সংবাদ-শিরোনাম হয়। হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবার কিংবা হোম ডেলিভারির খাবার নিয়ে বাঙালির রয়েছে অন্তহীন অভিযোগ। আবার হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারের জন্য অনেকে মুখিয়েও থাকেন। বাঙালির আড্ডায় খাবার নিয়ে বিভিন্ন কৌতুকেরও চর্চা হয়। তেমন কয়েকটি কৌতুক উল্লেখ করা যাক।
এক ভদ্রলোক তার বউকে ইংরেজি শিখতে বলেছে। তার বউ ইংরেজি শেখার জন্য খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে এবং ইংরেজি শেখার চেষ্টা করছে। একদিন তার বউ দুপুর বেলায় স্বামীকে ভাত খেতে দিয়ে বলল, এই নাও তোমার ডিনার।
স্বামী বলল, তুমি একটা গাধা। এখন হচ্ছে দুপুর আর তুমি এটাকে ডিনার বললে! এটাকে বলতে হবে লাঞ্চ।
জবাবে স্ত্রী বলল, তুমি একটা গাধা, তোমার চৌদ্দগুষ্টি গাধা! এগুলো গত রাতের বাসি ভাত। তাই এটা ডিনার। এবার বুঝলে?
এক লোক দোকানে গেছে চা খেতে। চায়ে চুমুক দিতেই সে বলল, ‘ছিঃ, কী দিছেন এইটা? এইটার মধ্যে তো পেট্রলের গন্ধ!’
দোকানদার নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘তাহলে স্যার আপনাকে ভুল করে কফি দেওয়া হয়েছে। কারণ আমাদের চায়ে লোকে ফিনাইলের গন্ধ পায়!’
স্ত্রীকে নিয়ে রফিক সাহেব গেছেন একটি কফির দোকানে।
রফিক সাহেব : তাড়াতাড়ি শেষ করো, কফি ঠান্ডা হচ্ছে।
স্ত্রী : কেন? সমস্যা কী?
রফিক সাহেব : আরে বুদ্ধু, মূল্যতালিকা দেখো। ‘হট কফি’ ৮০ টাকা, ‘কোল্ড কফি’ ১৬০ টাকা!