বাংলাদেশে প্রতি বৎসর রমজানের পূর্বে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাইতে দেখা যায়। এইবারও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। তবে এইবারের পরিপ্রেক্ষিত কিছুটা ভিন্ন ও অস্বাভাবিক। কেননা দীর্ঘসময় ধরিয়া চলা করোনা মহামারি, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ, বিশ্ব জুড়িয়া জ্বালানি তৈল ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, ডলার-সংকট, পরিবহন ব্যয়বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে এমনিতেই সমগ্র বিশ্বে টালমাটাল অবস্থা বিরাজমান। এই পরিপ্রেক্ষিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বাজারে পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানিয়া ধরা কঠিন বইকি। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ এখন বিপাকে রহিয়াছে। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠিতেছে। কোথাও কোথাও সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়াছে। ফলে শুধু কালোবাজারি, মুনাফাখোর ও মজুতদারদের দোষারোপ করিলেই চলিবে না।
রমজান মাসে প্রায় সকল পরিবারেই বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। এই মাস আত্মসংযমের হইলেও ধর্মপ্রাণ মানুষ অতিরিক্ত সওয়াব লাভের আশায় ইফতারি-সেহরিতে যেমন নিজে খান, তেমনি অন্যকেও খাওয়াইতে সচেষ্ট হন। এই মাসে হতদরিদ্র ও বুভুক্ষু মানুষ রমজান মাসের বরকতে তাহাদের ক্ষুধা অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক মিটাইয়া থাকে। ইহা নিঃসন্দেহে একটি ভালো দিক। তাহা ছাড়া গণভবন হইতে শুরু করিয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এই সময় ইফতার পার্টির আয়োজন করিয়া থাকে; কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী বাজারে বিভিন্ন পণ্যের জোগান বা সরবরাহ না থাকিলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাইবে ইহাই স্বাভাবিক। অবশ্য কিছুদিন পূর্বে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলিয়াছেন যে, রমজানের পূর্বে দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রহিয়াছে। তাই তিনি জনসাধারণকে আতঙ্কিত হইয়া কেনাকাটা না করিবার আহ্বান জানান। লক্ষ করিলে দেখা যাইবে, রমজানের কিছুদিন না যাইতেই দ্রব্যমূল্য কিছুটা হইলেও কমিতে থাকে। এই জন্য একত্রে অধিক বাজারঘাট না করিয়া সকলে যদি এই ব্যাপারে পরিমিতিবোধের পরিচয় প্রদান করেন, তাহা হইলে বাজারে হঠাৎ কৃত্রিম সংকট তৈরি হইবার কথা নহে।
এইখানে একটি বিষয়ের অবতারণা না করিয়া পারা যায় না যে, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে যখন রমজান মাসে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের মূল্য হ্রাস পায় এবং সরকারি-বেসরকারিভাবে মূল্যছাড়ের হিড়িক পড়িয়া যায়, সেইখানে উল্লেখযোগ্য বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশে ইহার ব্যত্যয় হয় কেন? যেমন এইবার রমজানের পূর্ব হইতেই সংযুক্ত আরব আমিরাত ১০ হাজারের অধিক পণ্যের মূল্য কমাইয়া দিয়াছে। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার ও ওমানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ সুপারশপ, বেকারি, রেস্টুরেন্টে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য ৫০ শতাংশ হইতে ৯০ শতাংশ কম রাখিতেছে। শুধু তাহাই নহে, রমজান উপলক্ষে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, কানাডাসহ ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশেও বিভিন্ন জরুরি পণ্যের মূল্য কমানো হইতেছে। তবে সেই সকল তৈলসমৃদ্ধ ও উন্নত দেশের কথা আলাদা। তাহারা সরকারিভাবে ভর্তুকির বিনিময়ে মানুষকে সন্তুষ্ট রাখিতেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা স্বপ্রণোদিত হইয়া মূল্য কমাইতেছেন; কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কৃষি, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে আর কত ভর্তুকি প্রদান সম্ভব? তাহা ছাড়া এইখানে ডলার-সংকট এখনো কাটে নাই। বর্তমানে এক ডলার সমান ১০৬ টাকা ৫০ পয়সা। গত এক বৎসরে বিভিন্ন খাতে সরকারের ট্যাক্স বৃদ্ধি পাইয়াছে বই কমে নাই। সম্প্রতি এক মাসেই বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পাইয়াছে দুই বার। গত ১৮ জানুয়ারি গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হইয়াছে ৮২ শতাংশ। উৎপাদনমুখী শিল্প-কলকারখানাগুলি এখনো জ্বালানিসংকটে ধুঁকিতেছে। তাই উৎপাদনে অতিরিক্ত খরচ হইলে তাহার প্রভাব সেই সকল পণ্যের বাজারে অবশ্যই পড়িবে।
এইদিকে পবিত্র মাহে রমজান অত্যাসন্ন হইলেও অফিস-আদালতে ঘুষ দেওয়া-নেওয়া ইত্যাদি কি বন্ধ হইয়াছে? ব্যাংকে কি সঠিক সময়ে এলসি খোলা যাইতেছে? দুই-চারটা ব্যাংক ছাড়া এই ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ ও বিড়ম্বনার কি কোনো শেষ আছে? এই জন্য এই ক্ষেত্রে বরং এই সম্পূরক প্রশ্ন উঠিতে পারে যে, ব্যবসায়ীরা যদি এইভাবে বহুমুখী চাপের মুখে থাকেন, তাহা হইলে তাহারা ন্যূনতম মুনাফা করিবেন কীভাবে? অতএব, অন্যান্য দেশে রমজানের সময় দ্রব্যমূল্য কেন হ্রাস পায় এবং আমাদের এইখানে বৃদ্ধি পায়—তাহা বুঝিতে অসুবিধা হইবার কথা নহে।