সংবাদপত্রের উদ্ভব হাজার বছর আগে। কাগজ আবিষ্কারের মতো চীনেই প্রথম ১৩০০ বছর আগে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। চীনে সরকারিভাবে সাও পাও নামে একটা পত্রিকা প্রকাশিত হতো, যার অর্থ রাজধানীর খবর’। প্রাচীন রোমে প্রকাশ হতো ‘এক্টা ডিউরনা’ অর্থাৎ ‘প্রতিদিনের ঘটনা’। এই দুটি পত্রিকা হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম সংবাদপত্র। ব্রিটিশ শাসিত আমেরিকা থেকে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকার নাম ‘পাবলিক অকারেন্সেস বোথ ফরেন অ্যান্ড ডমেস্টিক’ যার প্রকাশকাল ১৬৯০। কিন্তু মাত্র ৪ দিন পর সরকারবিরোধী লেখার কারণে ক্ষুব্ধ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার পত্রিকাটা বন্ধ করে দেয়। ১৭২৯ সালে বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনও ‘পেনসিলভনিয়া গেজেট’ নামে একটা পত্রিকা বের করেন, যিনি পরে সে দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন।
সংবাদপত্র ছাড়া কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চলতে পারে না। এ কারণে একে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। সংবাদপত্রের গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি উইলসন বলেছিলেন যে, সংবাদপত্র বিহীন রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র বিহীন সংবাদপত্রের মধ্যে যে কোনো একটা বেছে নিতে বলা হলে তিনি দ্বিতীয়টাকেই বেছে নেবেন।
যুগে যুগে দেশে দেশে সংবাদপত্রের ওপর দেশি-বিদেশি অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও নির্যাতন চলেছে। সাংবাদিকদের হামলা-মামলা এমনকি হত্যারও শিকার হতে হয়েছে। এসব উপেক্ষা করেই তারা দেশ-জাতি, সমাজ ও বিশ্বের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলে এ দেশের পত্রিকা সম্পাদক এবং সাংবাদিকরা শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছেন।
১৮৫৯ সালে বাবুবাজারে ‘বাংলাযন্ত্র’ নামে প্রতিষ্ঠিত ঢাকার প্রথম মুদ্রণালয় থেকে ১৮৬১ সালে ঢাকার প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ‘ঢাকা প্রকাশ’-এর সম্পাদক ছিলেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন বিদ্রোহী সাংবাদিকও। তাঁর সম্পাদনায় ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’ ও ‘লাঙ্গল’ নামে তিনটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল।
এ দেশের সাংবাদিকরা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাঁদের লেখার মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্র তৈরিতে সহায়তা করেছিলেন। আজাদ, সংবাদ, ইত্তেফাক, পূর্বদেশ, জনপদ, অবজারভার—এই দৈনিকগুলো ভাষা আন্দোলন থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এ কারণে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সংবাদ এবং ইত্তেফাক কার্যালয় পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধে শহিদুল্লাহ কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমেদ, শহীদ সাবের ও সেলিনা পারভিনসহ ১৩ জন সাংবাদিক শহিদ হন। ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজউদ্দিন হোসেনকে রাজাকাররা তাঁর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।
দেশের বিভিন্ন পত্রিকা তাদের জাতি-গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পত্রিকায় খবর প্রকাশের ফলে বড় বড় অনেক অপরাধী গ্রেফতার এবং শাস্তি পেয়েছে। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন তথ্যের জন্য টিভির চেয়ে এখনো পত্রিকাই বড় মাধ্যম। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং সাংবাদিকতায় আগ্রহীদের সংবাদপত্রের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ক্রমবিকাশ, বাংলাদেশের সব আন্দোলনে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ভূমিকা এবং সংবাদপত্রের প্রকাশনা ও মুদ্রণ সামগ্রীর বিবর্তন সম্পর্কে জানানোর জন্য কোনো সংগ্রহশালা গড়ে ওঠেনি। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সম্পর্কে অবগত করার জন্য দেশে একটা সংবাদপত্র জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।