শুক্রবার, ১০ মার্চ ২০২৩, সৌদি আরব ও ইরান সম্মত হয় যে দুই দেশ নিজেদের মধ্যে পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করছে এবং দুই মাসের মধ্যে পুনরায় দূতাবাস চালু হবে। ২০১৬ সালে সৌদিরা যখন শিয়া ধর্মীয় নেতা ও স্কলার এবং সৌদি রাজতন্ত্রের সমালোচক ‘নিম্র আল নিম্র-এর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে, প্রতিক্রিয়া হিসেবে একপর্যায়ে তেহরানে সৌদি দূতাবাস প্রতিবাদী জনতার দ্বারা আক্রান্ত হয়। সেই থেকে সৌদি কিংডম ও ইরানের সম্পর্ক একেবারেই নষ্ট অবস্থায় থাকে, একাধিক আঞ্চলিক সংঘর্ষের ক্ষেত্রে এই দুই বৃহত্তম শক্তি পরস্পরেরবিরোধী সাইডে অবস্থান নেয়।
মানতেই হয় যে চমৎকার, সুন্দর এই চুক্তিটি! সৌদি আরব ও ইরান নিজেদের সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট সব অস্বস্তি ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে অতিক্রম করে বিশ্ববাসীকে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা উপহার দিল। সেই সঙ্গে, চীনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা থেকে একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনীতির টেকটোনিক গতিবিধিও সুস্পষ্ট হয়ে গেল।
সৌদি, ইরান ও চীনের কর্মকর্তাদের যৌথ ঘোষণায় বলা হয় যে বেজিংয়ে কয়েক দিন ধরে আলাপ-আলোচনার পরে রিয়াদ ও তেহরান চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়; প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় যে কেউ কারো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ করবে না’। সম্পূর্ণ বিষয়টিকে এই পর্যায়ে রেডি করে আনার দায়িত্ব নিয়ে ইরাক ও ওমান ২০২১-২০২২ সালে প্রস্তুতিমূলক কর্ম সম্পাদন করে। অতিরিক্ত রূপে, রিয়াদ ও তেহরান বলে যে তারা ২০২১ সালে সইকৃত নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তিতে পুনরায় ফিরে যাবে এবং ‘আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার সম্প্রসারণে’ মনোযোগী হবে। ইরাকের গঠনমূলক ভূমিকা লক্ষণীয়। আশির দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষকে উত্সাহিত করেছে। অতঃপর, গণহত্যা-অস্ত্রের দোহাই দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দুই-দুইবার ইরাক আক্রমণ করে, লাখ লাখ মানুষ খামাখা নিহত হয়।
স্রেফ আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ নিয়ে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দুই বৃহত্তম শক্তির মধ্যে আপসরফা করিয়ে দিলেন! চীন বিশ্বীয় ভারসাম্যতা ও সুস্থিত অবস্থা সৃষ্টির নজির স্থাপন করল। বিগত অনেকগুলো দশক ধরে পশ্চিম এশীয় রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি অত্যন্ত প্রবল হওয়া সত্ত্বেও, ভূরাজনীতির এই বাসন্তীক্ষণে ধারেকাছে কোথাও যুক্তরাষ্ট্র নেই। এই অঞ্চলে ওয়াশিংটন সযত্নে বৈরী পরিবেশ লালন করে আসছে; নিরাপত্তা বিধানের নামে ওয়াশিংটন আরব মিত্রদের ইরানের সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে।
ফলস্বরূপ, গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক প্রশ্নে রিয়াদ-তেহরান মতানৈক্যের চূড়ান্তে উপনীত হয়। যেমন : ইয়েমেন ও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রিয়াদ ও ইরান (পারস্পরিকভাবে) বিরোধী সাইডকে সমর্থন করে, আবার লেবাননে ইরান যখন হেজবুল্লাহ আন্দোলনকে সমর্থন করে, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সঙ্গে রিয়াদ একজোট হয়ে হেজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী দল বলে গ্রহণ করে। ঐতিহ্যগতভাবে, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নিকটতম মিত্র ছিল সৌদি আরব। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন সৌদি নীতির পুনঃসংশোধনের নামে যুদ্ধাবসান ঘটানোর পরিবর্তে সৌদি-ইয়েমেন সীমান্ত বরাবর সশস্ত্র সংঘর্ষকে নবায়িত করে। বাইডেনের কাছে সৌদি-ইসরাইল সম্পর্ককে ‘নরমালাইজ’করণ প্রাধান্য পায়, এই উদ্দেশ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন জানুয়ারি মাসে (২০২৩) সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। কিন্তু সব সমস্যার মূল তো ইসরাইল-ফিলিস্তিন, ইসরাইল-সৌদি নয়! যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরাইলকে শর্তহীন ব্ল্যাংক চেক লিখে দেওয়া বন্ধ করত, তো পশ্চিম এশিয়ার হকিকত অন্যরকম হতো।
অন্যদিকে, ১৯৭৯ সাল থেকে ইরান যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের কঠিন কট্টর নিষেধাজ্ঞার স্থায়ী শিকারে পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই বৈদেশিক নীতি ‘আনুক্রমিক’ প্রেসিডেন্টরা ব্যবহার করে আসছেন, যেমন :পারমাণবিক অস্ত্র বিকাশ করলে ইরানকে কূটনৈতিক অথবা সামরিক পরিণতি ভোগ করতে হবে। এমনকি সম্প্রতি (৯.৩.২৩) মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণে যাওয়ার মুহূর্তে প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন হুমকি দেন যে ‘ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেওয়া হবে না।’ অস্টিনের আইকিউ যদি ঘরের তাপমাত্রার অনুরূপ হয়ে থাকে তো বিলক্ষণ জানেন যে ইরান যদি চাইত তো অন্তত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ‘ইরানি পারমাণবিক চুক্তি’টি ছিঁড়ে ফেলেন তখন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সংগত কারণ ইরানের ছিল। কিন্তু ইরান সে পথে যায়নি। উপসাগরীয় দেশগুলো বরং দেখে যে মিলিটারি সৃজনশীলতার মাধ্যমে ইরান ভিন্ন মেজাজের চমৎকার নতুন এক ‘শক্তি ভারসাম্য’ গড়ে তুলেছে।
এই ‘রিয়াদ-তেহরান সম্পর্ক পুনঃস্থাপন’ নিশ্চিতভাবে আলোচনার মাধ্যমে ইয়েমেন, সিরিয়া, এমনকি লেবাননের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মীমাংসা প্রচেষ্টায় ইতিবাচক প্রভাব রাখবে।
ইত্যবসরে বিশ্বমঞ্চে এমন পরিবর্তন ঘটে চলেছে যে মার্কিন ছত্রচ্ছায়ায় থাকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অনুধাবন করে যে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব আইডিয়োলজির পাইকারি বিশ্বায়ন ও বাস্তবায়ন তাদের জাতীয় স্বার্থের সর্বোত্তম বিকাশের পরিপন্থী। তারা তাই ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। যেমন : ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ফেব্রুয়ারি মাসে চীনের সঙ্গে তেল ও গ্যাসের নতুন চুক্তি সই করেছে। বা ওয়াশিংটন যখন দাবি করে যে ‘এফ-৩৫’ ফাইটার পেতে হলে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে তাদের ৫জি নেটওয়ার্কে ‘হুয়াভেই’কে বয়কট করতে হবে। উত্তরে আমিরাতিরা অবশ্য মার্কিনদেরকে বিকল্প ফাইটার প্রাপ্তির কথা বলে।
২০২২ সালের কয়েকটি ঘটনা বিশ্বমঞ্চের নবতর বিন্যাসকে তথা রি-অ্যালাইনকে ত্বরান্বিত করে। যেমন :ইউক্রেন যুদ্ধে ওয়াশিংটন উপসাগরীয় দেশগুলোকে পক্ষাবলম্বনের জোর চাপ দেয়। উপসাগরীয় দেশগুলো বলে যে ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নাই; তারা তাদের নিজস্ব পক্ষে রয়েছে, বা যার যার তার তার পক্ষে রয়েছে। অপেক্ষাকৃত খারাপ আরেকটি দাবি ছিল যে উপসাগরীয় দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সম্মিলিত পশ্চিমের অনুরূপ ‘নিষেধাজ্ঞা অ্যাজেন্ডা’ গ্রহণ করুক। যুক্তরাষ্ট্রের এই দাবি ওপেক মেনে নেয়নি এবং সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের তেল উত্পাদন বৃদ্ধির দাবিকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করে (দেখুন :‘জ্বালানি শক্তি পাওয়া যাবে?’, নাদিরা মজুমদার, দৈনিক ইত্তেফাক, ৪.১০.২০২২)। ২০২২ সালে ইসরাইলি ক্ষমতায় নেতানিয়াহুর প্রত্যাবর্তন আরব-ইসরাইলি টেনশনে ঘৃতাহুতির কাজ করে। কৌশলগতভাবে মূল্যহীন হলেও আবারও সিরিয়ায় যখন তখন বোমাবর্ষণ শুরু হয়, ইসরাইল-ফিলিস্তিন উত্তেজনার প্রবৃদ্ধি ঘটে। যেমন :এ বছরের (২০২৩) শুরুতে, আল-আকসা মসজিদের অভ্যন্তরে যে আকস্মিক হামলা হয় এবং তাতে ইসরাইলের নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গুয়ির-য়ের অনুমোদন ছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ‘স্ট্যাটাস ক্যু’ লঙ্ঘনকারীদের নিন্দা করার জন্য যে মিটিং ডাকা হয়েছিল সেটি বাগিবতণ্ডার মাধ্যমে শেষ হয়। ফলে, আসন্ন রমজান মাসে জেরুজালেমের পুরোনো শহরে ও আল-আকসাকেন্দ্রিক উত্তেজনা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ওয়াশিংটনের ‘সর্বোচ্চ চাপ স্ট্র্যাটেজি’ ইরানকে রাশিয়া ও চীনের প্রভাববলয়ে ঠেলে দিয়েছে। নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে তার জ্বালানি সম্পদের ব্যবসা-বাণিজ্য করতে দিচ্ছে না, পশ্চিমের ব্যাংকগুলোতে প্রবেশাধিকারও নিষিদ্ধ। কাজেই, অবশ্যম্ভাবী যে, তিন জ্বালানি শক্তি—রাশিয়া, ইরান ও সৌদি আরব মার্কিন ডলারকে পাশ কাটিয়ে ‘নতুন পেমেন্ট’ পদ্ধতির উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করবে! বাণিজ্যিক লেনদেনে সৌদি আরব ও ইরানের সঙ্গে চীনও ইত্যবসরে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক লেনদেনে মার্কিন ডলার পরিহার করা। সবাই জানে যে ‘বিশ্ব মুদ্রা’ হিসেবে মার্কিন ডলারের অবস্থানকে যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস করতে পারলে মার্কিন অর্থনীতি বিপর্যয়গ্রস্ত হতে পারে, তবে নিশ্চয় ভিনদেশে ‘সর্বদা যুদ্ধ’ ঘোষণা করা ও বিশ্বব্যাপী বৈশ্বিক হেজিমনি আরোপ করার সামর্থ্য আর থাকবে না। বিশ্বব্যাপী আটশর অধিক সামরিক ঘাঁটিও তার থাকবে না।