২০১২ সালে পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডে স্থাপনের মাধ্যমে প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানার যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশে। সেই পথ ধরে দেশে ইতিমধ্যে পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা ও বস্ত্রকল হয়েছে ১৮৩টি। এর মধ্যে চলতি বছরে পরিবেশবান্ধব কারখানার তালিকায় যুক্ত হয়েছে ১৫টি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে বিশ্বে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব পোশাক ও বস্ত্রকল রয়েছে। তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের পাশাপাশি শিপইয়ার্ড, জুতা ও ইলেকট্রনিক পণ্য খাতেও আছে পরিবেশবান্ধব কারখানা। বাণিজ্যিক ভবনও হচ্ছে পরিবেশবান্ধব, তবে সংখ্যায় কম।
বিশ্বের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে অন্যতম একটি যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)। তারা ‘লিড’ নামে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। লিড-এর পূর্ণাঙ্গ রূপ লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন। ইউএসজিবিসি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কাউন্সিল। পৃথিবী জুড়ে এটি পরিবেশবান্ধব ভবন ও কারখানা নির্মাণে পরামর্শ ও সহায়তা করে থাকে। এমনকি পরিবেশবান্ধব কারখানা বা স্থাপনা তৈরির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মানদণ্ডও রয়েছে তাদের। সংস্থাটির দেওয়া সনদ এখন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বিশ্বের বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এ সংস্থার সনদকে গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করে। এজন্য ইউএসজিবিসির সনদকে এ দেশের শিল্প উদ্যোক্তারাও বেশ গুরুত্ব দেয়। ইউএসজিবিসির তালিকায় শীর্ষ দশে থাকা সব কারখানা লিড প্লাটিনাম সনদ পেয়েছে। বিভিন্ন মানদণ্ডে ১১০ নম্বরের মধ্যে ৮০ বা এর বেশি নম্বর পায়, এমন কারখানাকে এ সনদ দেওয়া হয়। সনদটি পেতে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন মানদণ্ডে নির্ধারিত মান রক্ষা করতে হয়। নির্ধারিত মান বজায় রেখে নতুন ভবন নির্মাণ কিংবা পুরোনো ভবন সংস্কার করেও এ সনদের জন্য আবেদন করতে পারে কারখানাগুলো।
১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউএসজিবিসির অধীনে কলকারখানার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভবন স্কুল, হাসপাতাল, বাড়ি, বিক্রয়কেন্দ্র, প্রার্থনাকেন্দ্র ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব স্থাপনা হিসেবে গড়ে তোলা যায়। লিড সনদের জন্য ৯টি শর্ত পরিপালনে মোট ১১০ পয়েন্ট আছে। এর মধ্যে পয়েন্ট ৮০-এর ওপরে হলে ‘লিড প্লাটিনাম’, ৬০-৭৯ হলে ‘লিড গোল্ড’, ৫০-৫৯ হলে ‘লিড সিলভার’ এবং ৪০-৪৯ হলে ‘লিড সার্টিফায়েড’ সনদ মেলে। বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব স্থাপনাগুলো অধিকাংশই ইউএসজিবিসির অধীনে সনদ পেয়েছে। প্রতি বছরই পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার তালিকায় নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হওয়াটা খুবই ইতিবাচক। এতে সামাজিক ও পরিবেশগত সুবিধা পাচ্ছি আমরা। তবে ব্যবসায়ে এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না। এ ক্ষেত্রে দেশ হিসেবে পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার ব্র্যান্ডিং না করতে পারাটাই মূল সমস্যা। কিছু প্রতিষ্ঠান নিজেরা চেষ্টা করে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পোশাকের বাড়তি দাম নিতে পারছে। তবে অধিকাংশই পারছে না। ব্যাবসায়িক সুবিধা নিতে পারলে পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা স্থাপনে আরও বেশি আগ্রহী হতেন উদ্যোক্তারা। লিড তালিকায় থাকা সবচেয়ে বেশি কোম্পানি বাংলাদেশের। এরপর সবচেয়ে বেশি কোম্পানি আছে চীনের। তাদের আছে ১০টি কারখানা। এরপর পাকিস্তানের আছে ৯টি কারখানা। শ্রীলঙ্কা ও ভারতের আছে ছয়টি করে কারখানা। ভিয়েতনাম ও তাইওয়ানের আছে চারটি করে কারখানা।
পরিবেশবান্ধব শিল্পকারখানা স্থাপনে একের পর এক নতুন রেকর্ড করছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১ নম্বর পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত গ্রিন টেক্সটাইল লিমিটেডের চতুর্থ ইউনিট। নতুন নতুন পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব কারখানার রিসার্টিফিকেশন প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। তার মানে আমরা দ্বিতীয় পরিবেশবান্ধব কারখানার দ্বিতীয় পর্যায়ে পদযাত্রাও শুরু করেছি। এর মাধ্যমে আমাদের উদ্যোক্তারা দেখিয়ে দিয়েছেন, পরিবেশবান্ধব কারখানার উন্নয়নেও কাজ করছেন তারা। এ অর্জন বাংলাদেশের এসডিজির লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সুনামও বিশ্বে অনেক বাড়িয়ে দেবে। বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো যে কোনো ক্রয়াদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ স্বীকৃতির বিষয়টি বিবেচনায় নেবে। পরিবেশবান্ধব কারখানায় প্রতিযোগী দেশগুলোর কেউই বাংলাদেশের ধারে কাছে নেই। আশা করা যায়, বৈশ্বিক এ স্বীকৃতি পোশাকের দাম বাড়াতে সহায়তা করবে। লিড সনদে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া পরিবেশবান্ধব কারখানাগুলোতে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক উৎসকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে কারখানায় ৬০-৭০ শতাংশ পানি ব্যবহার করা হয় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে। এছাড়া কারখানাগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে সবুজ জ্বালানির ব্যবহার বেশি করা হয়। কারখানার বিদ্যুতের চাহিদার ৮০ শতাংশই পূরণ করা হয় সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে। এছাড়াও রয়েছে টেকসই কারখানা প্রাঙ্গণ, দক্ষতার সঙ্গে পানির ব্যবহার, টেকসই জ্বালানি ও পরিবেশ, উপকরণ ও সম্পদ, উদ্ভাবন ও আঞ্চলিক অগ্রাধিকার ইত্যাদি। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসে পোশাকশিল্প খাত থেকে। তবে মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপের মধ্যে এ খাত নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। বাতিল হয়ে যায় অনেক অর্ডার। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে স্বরূপে ফিরতে খুব বেশি দেরি হয়নি। অল্প সময়ের ব্যবধানে বাতিল হওয়া অর্ডারগুলো পুনরায় ফিরে আসতে থাকে। ফলে করোনার মধ্যেও চমক দেখিয়েছে পোশাকখাত। একই সঙ্গে বেড়েছে পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা বা গ্রিন ফ্যাক্টরির সংখ্যাও।
বিগত চার দশকে একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পেছনে আমাদের যে যাত্রা তার মূলে রয়েছে শিল্পের অভাবনীয় বিকাশ, বিশেষ করে শ্রমনির্ভর ম্যানুফ্যাকচারিং খাত। ৭০ দশকের শেষের দিকে যাত্রা শুরু করে ইতিমধ্যে বিশ্ববাজারে আমরা দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছি। এই শিল্পের জিডিপিতে অবদান ১১ শতাংশ। দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে অব্যাহত অবদান রাখার পাশাপাশি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত, শ্রমিকের ক্ষমতায়ন এবং সবুজ শিল্পায়নেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এই শিল্প।