২০০৭ সাল। দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলো। চলছে এক-এগারোর রাজনীতি। সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী বন্দি। সংস্কারবাদীদের নিয়ে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়নে শাসকশ্রেণি তৎপর। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয় ১৬ জুলাই। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন মো. জিল্লুর রহমান। আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভেদের সুর। অনেক নেতাকর্মীর অবস্থা কাহিল। হয় আপস করো, না হয় জেলে ঢোকো—এমন বাস্তবতা। জিল্লুর রহমান একপ্রকার গৃহবন্দী। প্রচারণা আছে, তাকেও দেখা যেতে পারে নতুন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে। জিল্লুর রহমানের সামনে একদিকে আপস করে ক্ষমতার বড় পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ, অন্যদিকে আপসহীন থেকে জেলে বন্দিত্বের জীবন বেছে নেওয়ার পথ। তিনি আপস করেননি আবার তাত্ক্ষণিকভাবে বিদ্রোহও করেননি।
সংকটাপন্ন সেই সময়ে সাংবাদিকেরা জিল্লুর রহমানকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিচ্ছেন, নাকি নিচ্ছেন না? জিল্লুর রহমান তখন প্রতিক্রিয়াহীন। কিছুই বললেন না। তার অভিব্যক্তি বোঝা কঠিন। নারী সাংবাদিক আবার বললেন, ‘চাচা, শুধু হ্যাঁ অথবা না বললেই চলবে, আমরা চলে যাব, আর কোনো প্রশ্ন করব না।’ নিজ বাসভবন থেকে বের হওয়ার সময় লিফটের সামনে সাংবাদিকেরা তাকে ঘিরে আছেন। আমরাও পাশে দাঁড়ানো। শুরুতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার প্রোগ্রাম আছে, আমাকে যেতে হবে।’ তখন তাদের একজন বললেন, ‘চাচা, মাত্র একটি প্রশ্নের উত্তর দিন, তাহলেই আমরা চলে যাব।’ তারপর সেই প্রশ্ন, যার প্রতিক্রিয়ায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ মন্তব্যই তখন বিরাট ফ্যাক্টর। সক্রিয় রাজনীতিতে প্রায় ৫০ বছরের অভিজ্ঞ জিল্লুর রহমান বললেন, ‘মাগো, মহামান্য রাষ্ট্রপতি অনেক সম্মান ও মর্যাদার পদ। এত বড় পদ সম্পর্কে দাঁড়িয়ে কথা বললে পদটিকে অসম্মান করা হবে। আজকে আমার জরুরি কাজ আছে। মাগো, আমাকে যেতে দাও। আরেক দিন এসো, আমি এ বিষয়ে কথা বলব।’ জিল্লুর রহমানের বিনয় ও বিচক্ষণতার কারণে সেদিন খ্যাতিমান, প্রভাবশালী সাংবাদিকেরা পথ ছাড়লেন।
ওয়ান ইলেভেনের প্রেক্ষাপটে জিল্লুর রহমান হয়তো রাজনীতির ইতিহাসটা পালটে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। শুরুতে তার অন্তর্নিহিত চিন্তা-ভাবনাও কাউকে বুঝতে দেননি। সেনাসমর্থিত শাসকদের রক্ষচক্ষুর অন্তরালে ধীরে ধীরে তিনি নেতাকর্মীদের প্রস্তুত করলেন। রাজনীতির সংকটকাল অত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে মোকাবিলা করলেন। এবং একসময় উচ্চারণ করলেন, ‘নো শেখ হাসিনা, নো ইলেকশন’। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সম্মেলন নিয়েও তিনি বলেছিলেন, ‘নেত্রী জেলে, এই মুহূর্তে দলাদলি কীসের? নেত্রীকে জেলে রেখে কীসের সংস্কার? তাকে ছাড়া দলের কাউন্সিল নিয়ে ভাবি না।’ শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো। নির্বাচন ও সম্মেলন দুটোই শেখ হাসিনার অংশগ্রহণে হলো।
আদর্শবাদী, দূরদর্শী, উদার রাজনীতিক মো. জিল্লুর রহমান মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন সভাপতি, তখন তিনি প্রথমবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যখন সভাপতি, তখন তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। জিল্লুর রহমান আজীবন দলের আদর্শ ও লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন। এক-এগারোর সামরিক শাসনের সময় তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সহনশীলতা, দক্ষতা, সহজ-সরল আচরণ, যোগাযোগের কলাকৌশল এবং দেশ ও জনগণের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যনিষ্ঠা রাজনীতির মানুষকে নতুন শিক্ষায় উদ্বেলিত করেছে। জাতির ঐ ক্রান্তিকালে তিনি শুধু শেখ হাসিনার মুক্তি আন্দোলনের প্রধান কাণ্ডারি হননি, হয়ে উঠেছিলেন গোটা রাজনীতি পুনরুদ্ধারের বাতিঘর।
জিল্লুর রহমানের সান্নিধ্যে যারাই গেছেন, তারাই তার নম্রতা, ভদ্রতা, উদারতার প্রশংসা করেছেন। ২০০০ সালে তিনি যখন মাননীয় মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, তখন তার বিনয় ও ভদ্রতার দৃষ্টান্ত দেখে আমিও অনুপ্রাণিত হয়েছি। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ, ভৈরবের সাধারণ সম্পাদক। একটি অনুষ্ঠানের অতিথি করতে আমরা কয়েকজন তার মন্ত্রিপাড়ার বাসভবনে যাই। আমাদের অভিপ্রায় শোনার পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, জাতীয় পত্রিকার সম্পাদক এবং আরো কয়েকজন গুণী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। উপাচার্যের সঙ্গে তার টেলিফোন আলাপটি ছিল এরকম—‘আস্সালামু আলাইকুম, কেমন আছেন? অক্টোবরের ২০ তারিখে আমার ভৈরবের একটি অনুষ্ঠানে ছেলেরা আপনাকে অতিথি হিসেবে নিতে চায়। আমি নিজেও অনুষ্ঠানে থাকব। আপনি যদি একটু সময় করে আমার ভৈরবে আসেন, তাহলে আমি অনেক কৃতজ্ঞ হব। আমার ছেলেরাও অনেক খুশি হবে…।’ আমরা যখন উঠব, ঠিক সেই সময় তিনি আমাকে বললেন, ‘শোন সেক্রেটারি, আমি ভৈরবের, ভৈরব আমার; আমি সব সময়ই তোদের প্রোগ্রামে যাই। কিন্তু যাদের দাওয়াত করেছিস, তারা কিন্তু ভৈরবের মেহমান। খেয়াল রাখিস, তাদের যেন কোনো অসম্মান না হয়।
মো. জিল্লুর রহমানের বর্ণাঢ্য জীবনে অসম্মানজনক বা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের দৃষ্টান্ত বিরল। তার রাজনৈতিক শিষ্টাচার, বিনয়, বদান্যতা এবং ব্যক্তিগত জীবনস্মৃতি উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ১৯২৯ সালের ৯ মার্চ তিনি ভৈরবে জন্মগ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ২০১৩ সালের ২০ মার্চ আজকের দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয়। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীসহ দলমত-নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তাকে শ্রদ্ধা জানান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ইতিহাসে এটিও একটি অনন্য নিদর্শন। অনুকরণযোগ্য সংস্কৃতি। তার মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।