একটি সমাজ ব্যবস্থাপনায় যে কাজের মাধ্যমে সমাজের ইতিবাচক ও গঠনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজের চিত্র আমূল বদলে ফেলা হয়, তা-ই হচ্ছে সমাজকর্ম। সমাজকর্ম বিশেষায়িত পেশা। আধুনিক বিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটি বিষয় পেশাকেন্দ্রিক, এর মধ্যে সমাজকর্ম অন্যতম। সমাজের ভিত্তি স্থাপন থেকে শুরু করে কাঠামোগত ভিত মজবুতে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন সমাজকর্মীরা। সমাজের বিশেষ লক্ষ্যপূরণ ও চিহ্নিত সমস্যা সমাধান করে আদর্শ সমাজ বা সম্প্রদায় গঠন করাই সমাজকর্মের মুখ্য উদ্দেশ্য।
প্রতি বছর মার্চ মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার সমাজকর্মের প্রচার, প্রসার ও মানব সম্পর্কের উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় ‘বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস’। অর্থাৎ, বিশ্বব্যাপী সমাজকর্ম দিবস পালিত হচ্ছে আজ। উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও প্রতি বছর সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালন করা হয় বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস। প্রযুক্তির বদৌলতে সময় যখন প্রতিনিয়ত আধুনিকতর হচ্ছে, তখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সমাজের নানামুখী সমস্যা। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতেও সামাজিক সমস্যা ক্রমাগত বাড়ছে। যৌতুক, বাল্যবিবাহ, খুন, অপরাধ, ধর্ষণ, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, মানবাধিকার ও নিরাপত্তাজনিত সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব সমস্যার কারণে সমাজের ভিত্তিমূলের অবস্থা তথৈবচ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে চিহ্নিত সামাজিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে পেশাদার সমাজকর্মীর সংখ্যা নেহাত কম। দেশে এখনো পেশাদার সমাজকর্মীদের স্বীকৃতি প্রদানের সংস্কৃতি ও প্রক্রিয়াগঠন সম্ভবপর হয়নি। বিষয়টি লাখো সমাজকর্ম স্নাতকের জন্য হতাশাজনক বইকি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পেশাদার সমাজকর্মীরা অর্জিত স্বীয় জ্ঞান, দক্ষতা, কলাকৌশল, দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের উপযুক্ত ক্ষেত্র পেলেও আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েট সমাজকর্মীদের কাছে সেই ক্ষেত্রটি এখনো অধরা। এক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ সমাজকর্মী সরবরাহ করা গেলে সমাজের গুরুতর সমস্যাগুলো সমাধানের পাশাপাশি সমাজের সব মানুষ নিজেদেরকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার অনুকূল পরিবেশ পেতে পারে। এতে করে একজন দক্ষ সমাজকর্মী সমাজের বিশেষ সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে পারবে। বৈজ্ঞানিক গবেষণানির্ভর সমাজকর্মী সমাজের প্রতিটি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা ও মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা নিয়েও কাজ করতে পারবে। সর্বোপরি মানুষের আর্থসামাজিক জীবনযাত্রার মান পরিশীলিত হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও সরকারঘোষিত রূপকল্প-২০৪১ অর্জনে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারবে পেশাদার সমাজকর্মীরা।
হতাশার সংবাদ হলো, প্রচলনের এত বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের দেশে এখনো মেলেনি সমাজকর্মের স্বীকৃতি। সময় এসেছে, উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও সমাজকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া গ্রহণ করার। ইউনিয়ন সমাজকর্মী, উপজেলা সমাজসেবা অফিসার, জেলা সমাজসেবা অফিসার—এই পদগুলো স্নাতকধারী সমাজকর্মীদের জন্য সংরক্ষিত করা বিচক্ষণ চিন্তা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে সমাজকর্মে স্নাতকদের জন্য উচ্চতর শিক্ষা অর্জনে বিভিন্ন স্কলারশিপ চালু করতে হবে। তাছাড়া প্রতিটি সমাজকর্মীকে সরকারিভাবে নিবন্ধিত হওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে একজন সমাজকর্মী ব্যক্তিগত উদ্যোগে ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষকের মতো সমাজের গঠনগত পরিবর্তনে কাজ করতে পারে।
সমাজকমের্র শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্ব সমাজকর্ম দিবসে এই প্রত্যাশা ও আশাবাদ ব্যক্ত করি, অচিরেই সমাজকর্মের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করা হবে। যার মাধ্যমে লাভবান হবে সমাজের প্রতিটি মানুষ। সমাজের মানুষ হয়ে উঠবে আরো সৃজনশীল, আধুনিকমনস্ক, স্বশিক্ষিত। বিশ্ব সমাজকর্ম দিবসের স্লোগান হোক এটাই।