জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিদ্যমান আয়কর আইন পরিবর্তন এবং পরিমার্জনের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য, বিশ্বায়ন প্রেক্ষাপটে মুক্তবাজার অর্থনীতির জন্য নয়া আয়কর আইনটির দাবি বহু দিনের। দেশে যে আয়কর আইন প্রচলিত আছে তা আক্ষরিক অর্থেই শত বছরের পুরোনো। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯২২ সালে ভারতীয় আয়কর আইন নামে যে আয়কর আইন প্রবর্তিত হয়েছিল তার নাম এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামান্য কিছু পরিবর্তন এবং বছর বছর অর্থবিধির মাধ্যমে পরিমার্জিত রূপে প্রচলিত রয়েছে। ‘ঔপনিবেশিক’ আমলে প্রণীত ও প্রবর্তিত একটি আইন কখনোই স্বাধীন দেশের জন্য উপযোগী হতে পারে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আইনটি পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে হালনাগাদের খসড়া মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিতে পেরেছে। এটি এখন জাতীয় সংসদের এক্তিয়ারে।
আগের আইনটি প্রণীত হয়েছিল এমন এক অবস্থায় যেখানে করদাতাদের সঙ্গে কর আদায়কারীদের সম্পর্ক ছিল রাজা এবং প্রজার মতো। আইনটি এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছিল যেখানে করদাতার আয় হোক আর না-ই হোক তার কাছ থেকে কর আদায় করা হতো। কর ন্যায্যতার বিষয়টি সর্বজনীন প্রেক্ষাপটে না হয়ে সীমিত পরিসরে দরকষাকষির পর্যায়ে চলত। দেশে এখনো করদাতার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুবই কম। অথচ দেশে কর প্রদানের মতো যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। অর্থনীতি অনেক বড় এবং শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু কর ‘আহরণে’র হার সেভাবে বাড়ছে না।
বিদ্যমান আয়কর আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের একটি বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, যে প্রতিষ্ঠান আইন প্রণয়ন করে তারাই আইন বাস্তবায়ন করে। হোয়াইট কালার ব্যুরোক্র্যাটরা এমনভাবে আয়কর আইন প্রণয়ন করেছিল যাতে তাদের আয়কর দিতে না হয় বরং কমিশন পায়। এখন উপজেলা পর্যায়েও অনেকেই কর প্রদানের সামর্থ্য রাখেন। কিন্তু তাদের সঠিকভাবে করের আওতায় আনা যাচ্ছে না। স্বাধীন বাংলাদেশ একটি গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ, কাজেই এমন আয়কর আইন প্রণয়ন করতে হবে যা আধুনিক এবং জনকল্যাণমূলক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আয়কর আইনের খসড়া তৈরি করেছে। কিন্তু তারা তো নীতি প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান নয়। তারা হচ্ছে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান। নীতিনির্ধারক এবং বাস্তবায়ন কাজ যদি একই প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকে তাহলে প্রয়োগে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর এক দশকের মধ্যেই ভারতীয় প্রজাতন্ত্র কর্তৃপক্ষ ‘আইন কমিশনে’র মাধ্যমে ১৯২২ সালের আয়কর আইন পরিবর্তন করে স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি আয়কর আইন প্রণয়ন করে। ভারতীয় আয়কর আইন কিন্তু তাদের রাজস্ব বোর্ড মুসাবিদা করেনি। তাদের আয়কর আইন প্রণয়ন করেছে ভারতীয় আইন কমিশন। আয়কর আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ অফিসার ও বিশেষজ্ঞদেরও কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করে তারা কয়েক বছরের মধ্যেই একটি উপযোগী এবং কার্যকর রাজস্ব আইন প্রণয়ন করে। ফলে ভারতীয় আয়কর আইনটি জনগণের আয়কর আইনে পরিণত হয়।
পক্ষান্তরে ভারত বিভাগোত্তর পাকিস্তানে বিদ্যমান ব্রিটিশ আয়কর আইন পরিবর্তন না করে বিদ্যমান আইনটিই বছর বছর সামান্য কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে পাকিস্তানের জন্য প্রয়োগ করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও আয়কর আইন পরিবর্তনের তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। শুধু যেখানে পাকিস্তান লেখা ছিল সেখানে বাংলাদেশ লেখা হয়েছে। এ ধরনের সামান্য কিছু শাব্দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পুরোনো আইনটিই বলবৎ রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমেই যেসব কাজ করেছিলেন বা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার মধ্যে প্রচলিত আয়কর আইনের সংস্কার ছিল অন্যতম। এইচ টি ইমাম সাহেবের বইয়ে পাচ্ছি আয়কর ও রাজস্ববিষয়ক কিছু কিছু আইনের সংস্কার শুরু হয়েছিল। অবশেষে ১৯৮৪ সালে তৎকালীন সামরিক সরকার আয়কর আইনে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু ভালোভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ১৯৮৪ সালে আয়কর ‘অধ্যাদেশ’ আকারে জারি করা হয় তা সময়ের চাহিদা পূরণের জন্য খুব একটা উপযোগী ছিল না। ১৯২২ সালের ভারতীয় আয়কর আইনটিই কিছুটা পরিবর্তন ও পরিমার্জনপূর্বক অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রচলন করা হয়। ১৯৯০ সালের পর থেকে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকেই স্বাধীন দেশের উপযোগী করে একটি আয়কর আইন প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উত্থাপিত হতে থাকে। উন্নয়ন সহযোগীরাও এ ব্যাপারে তাগিদ দিচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে আয়কর আইন তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আয়কর আইন প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। যারা আইন বাস্তবায়ন করবেন তাদেরই আইন প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হলে প্রণীত আইনে তাদের মতামত এবং প্রয়োগকালে ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আইনের যে ভাষ্য পছন্দ করবে তারা সেটাই অন্তর্ভুক্ত করাতে চাইবে। সেটা জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে নাকি প্রতিকূলে তা তারা বিবেচনার নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ সেখানে থাকে না। আইনের বাস্তবায়ন যেভাবে সহজ হবে তারা সেভাবেই আইন প্রণয়নের চেষ্টা করবে। অথচ যে কোনো আইন এমনভাবে তৈরি করা দরকার যা যুক্তিযুক্ত, কর ন্যায্যতা ও বিচার নিশ্চিত হয় এবং রাজস্ব আহরণে সহায়ক হয়। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এ ধরনের সংস্থাগুলো দেশের উপযোগী একটি আয়কর আইন প্রণয়নের জন্য বারবার তাগিদ দিয়ে আসছে। কিন্তু মেইন যে স্টেকহোল্ডার, করদাতাদের প্রতিনিধি সেই জাতীয় সংসদ কর্তৃক আইনটি প্রণয়ন ও পাশের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্তির কোনো বিকল্প নেই। জাতীয় সংসদের সদস্যবৃন্দ দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে এমন একটি আইন প্রণয়ন করবেন যা হবে দীর্ঘমেয়াদি এবং বারবার সংশোধনের প্রয়োজন পড়বে না। আমাদের রুলস অব বিজনেসে এমন সিস্টেম আছে, যেখানে যে মন্ত্রণালয় আইনগত কিছু করতে চায়, তারা তা করবে। একপর্যায়ে আইন মন্ত্রণালয় থেকে তা ভেটিং করিয়ে নিলেই হবে। আইন মন্ত্রণালয় শুধু দেখে প্রস্তাবিত আইনের মধ্যে সরকারবিরোধী কিছু আছে কি না। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনটি কতটা বাস্তবসম্মত এবং জনকল্যাণমূলক তা তারা বিবেচনা করে না। আমি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালে দেখেছি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেও সংশ্লিষ্ট শাখাকে দায়িত্ব দেওয়া আছে, বাজেট দেওয়া আছে। তাদের দায়িত্ব হলো প্রস্তাবিত আইনটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে ভেটিং করিয়ে আনা। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের যে ভূমিকা তা এখানে অনুপস্থিত। এর আগেও একাধিক বার আয়কর আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। এবার বিভিন্ন মহল থেকে চাপ আসায়, বিশেষ করে আইএমএফ রাজস্ব বাড়ানোর জন্য জোর তাগিদ দেওয়ার ফলে নতুন আয়কর আইন প্রণয়নের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গত ডিসেম্বর মাসে নতুন আয়কর আইনের একটি খসড়া জাতীয় সংসদে নিয়ে গেছে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আয়কর আইনের যে খসড়া তৈরি করেছে তা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কতটুকু আলোচনার মাধ্যমে করা হয়েছে। কিছু কিছু স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করা হলেও তাদের সুপারিশগুলো খসড়া আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কি না তা তাদের জানানো হয়নি। ফলে এক্ষেত্রে একধরনের ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। প্রস্তাবিত আইনটি আরো গ্রহণযোগ্য করার জন্য আরো খোলামেলা আলোচনার সুযোগ দেওয়া উচিত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যে খসড়া প্রণয়ন করেছে সেটা এখন জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রকাশ করা যেতে পারে। জাতীয় সংসদ এ উদ্যোগটি নিতে পারে। এই আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রস্তাবিত আইনটি বাংলা ভাষায় প্রণয়ন করা হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আইনে লেখা আছে, একটি আপিল বোর্ড থাকবে। তারপর ক্যাবিনেট থাকবে, তারপর কোর্ট যাবে। আপিল বোর্ডে নিরপেক্ষ লোক অর্থাৎ বিচার বিভাগের সদস্য থাকবেন। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আপিল বিভাগে বিচার বিভাগের লোককে স্বাগত জানাতে চান না, যারা আসেন তারা এখানে বিব্রত বোধ করে চলে যান। ২০০৫ সালে আইন করেই ‘কর ন্যায়পাল’ অফিস স্থাপন করা হয়েছিল। কর ন্যায়পাল অফিস সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল করদাতাদের মধ্যে আস্থার পরিবেশ তৈরি করা। শুল্ক ও কর কর্মকর্তারা ভিন্ন ব্যাখ্যার আবরণে যদি করদাতা বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতানৈক্য বিবাদে আপতিত হন তখন কর ন্যায়পাল অফিসে অভিযোগ করলে তার প্রতিকার চাওয়া বা পাওয়া যেত। অর্থাৎ করদাতা এবং কর আদায়কারীর মধ্যে একধরনের ভারসাম্য সৃষ্টি করা। কিন্তু ২০১১ সালে কর ন্যায়পাল অফিস তুলে দেওয়া হয়। বলা হলো, আমাদের আয়কর আইনে এ ধরনের কোনো অফিস স্থাপনের ব্যবস্থা নেই। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, প্রস্তাবিত আইনে কর ন্যায়পাল অফিস স্থাপনের বিধান রাখা হয়েছে কি না। করদাতারা কর দিচ্ছেন কিন্তু যারা কর আদায় করছেন সেই রাজস্ব বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কোনো ব্যবস্থা আইনে আছে কি না। আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের কিস্তি পাওয়ার আশায় তড়িঘড়ি করে ২০১২ সালে আইন তৈরি ও পাশ করা হয়। কিন্তু সেই আইন বাস্তবায়নে বেশ বেগ পেতে হয়েছে, বিলম্ব হয়েছে। রাষ্ট্রের রেভিনিউ স্বার্থ বিঘ্নিত হয়েছে বা হচ্ছে। মহান জাতীয় সংসদের ৭০ শতাংশের বেশি সদস্য ছিলেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, স্টেকহোল্ডার। তারা যে ভ্যাট আইন পাশ করেছিলেন, সেই আইন বাস্তবায়ন করার সময় সেই স্টেকহোল্ডাররাই আপত্তি জানালেন। প্রস্তাবিত নতুন আয়কর খসড়া আইন পরীক্ষা পাশ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও যেন তেমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতির উদ্ভব না হয়।