পদ্মা নদীর লৌহজং চ্যানেল বেঁকে ঢুকেছে মাদারীপুরের শিবচরে। ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরী (কাঁঠালবাড়ী) বাংলাবাজার ফেরিঘাটের পাশে সরু হয়ে বয়ে গেছে চিরযৌবনা এই নদী। স্থানীয় লোকজন এই চ্যানেলকে বলে ‘বিলপদ্মা’। এই নদীর পারে এখন উৎসবের মহাযজ্ঞ।
গতকাল শুক্রবারই সেখানে পৌঁছতে পথে পথে নিরাপত্তা তল্লাশিতে পড়তে হলো। সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ ও র্যাবের টহল গাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে পুরো এলাকা। পথে পথে ব্যানার-ফেস্টুনে উৎসবের আমেজ।
ফেরিঘাটের কাছে দেখা গেল নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যেও স্থানীয় উত্সুক মানুষ ভিড় করেছে। আছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী। জনসভায় যোগ দিতে অনেকেই চলে এসেছে আগে থেকে। তাদের একজন পাশের কাদেরপুর ইউনিয়নের আব্দুল হাকিম (৫০)। তিনি বলেন, ‘আমাদের সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল ঢাকার লগে একটা সেতু হইবে। আমাগো নেত্রী সেই স্বপ্ন পূরণ করছে। এখন চালু হইব। ঘরে থাকতে কী মন চায়!’
হাকিমের মতো অনেকেই উৎসবের চূড়ান্ত সময়ের অপেক্ষায়। তাঁদের আশা, ১০ লাখের বেশি মানুষ উপস্থিত হবে বিলপদ্মার পারে। আজ শনিবার এখানেই দেশের সবচেয়ে বড় জনসভা করার লক্ষ্য ঠিক করেছেন আয়োজকরা। পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন উপলক্ষে পদ্মা সেতুর আদলেই তৈরি মঞ্চে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই মধ্যে উদ্বোধনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিসরে নিরাপত্তার আয়োজন করা হয়েছে পদ্মা সেতুকে ঘিরে। সেতুর মাওয়া প্রান্ত থেকে জাজিরা, শিবচরের প্রতিটি জায়গায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। আজকের জনসভায় যোগ দিতে তৈরি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, স্থানীয় সব প্রশাসন ও সাধারণ জনগণও। আজ উদ্বোধনের পরই আলোকবাতি প্রদর্শন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মিষ্টি বিতরণসহ বেশ কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে পদ্মার দুই পারের বাসিন্দারা। গতকাল থেকেই এসব উৎসবের রং ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। সন্ধ্যায় পদ্মার দুই ধারে বাতি জ্বলে ওঠে। উজ্জ্বল আলোয় রঙিন হয়ে ওঠে পদ্মার পার।
গতকাল বিকেলে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটসংলগ্ন জনসভাস্থল পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী এখন যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে। আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছেন, সব নিরাপত্তা বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য তৈরি হয়ে আছে। পুরো এলাকা সিসিটিভির আওতায় আসছে। আমাদের নৌ পুলিশ, পুলিশ ও র্যাব প্রয়োজন বোধে আমাদের বিজিবিও আসবে। এখানে যথেষ্ট পরিমাণ স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন, দলীয় স্বেচ্ছাসেবকরাও রয়েছেন। তাঁরাও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করবেন। ’
১০ লাখ মানুষের জমায়েত হওয়ার আশা করছে আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে সমাবেশে জমায়েত ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। সারা বাংলাদেশে জনতার যে উৎসব দেখছি, যে আনন্দ দেখছি, তারা সেতু দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। ’
পদ্মা সেতুর আদলে তৈরি মঞ্চটি ১১টি পিলারের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। মঞ্চ থেকে প্রায় ২০ ফুট দূরে নৌকা দিয়ে একটি নদীর আদল তৈরি করা হয়েছে। মঞ্চের চারপাশ ঘিরে রয়েছেন পোশাকধারী ও সাদা পোশাকের প্রশাসনের লোকজন। বাঁশ দিয়ে পুরো এলাকায় বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। সভার প্রথম স্তরে বিশেষ ব্যক্তিরা ছাড়া কেউ যেতে পারবেন না। মাঠজুড়ে বসানো হয়েছে মনিটর। এলাকাজুড়ে মাইক। গতকাল বিকেলে মঞ্চের মাইক পরীক্ষা করা হয়। পুরো এলাকা রেকি করেছেন পুলিশ, সেনা বাহিনীর সদস্য, র্যাব, নৌ পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।
গতকাল নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, উদ্বোধন ও সমাবেশকে ঘিরে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ যারা লঞ্চে আসবে, তাদের লঞ্চ ভেড়ানোর সুবিধার জন্য ২০টির মতো পন্টুনের ব্যবস্থা, চলাচলের পথ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিআইডাব্লিউটিএর পক্ষ থেকে করা হয়েছে।
সকালে সভাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘পদ্মা সেতু শুধু আমাদের দেশের ইস্যু নয়, এটা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আলোচনায় রয়েছে। তাই যেকোনো হুমকি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে মোকাবেলা করা হবে। ’
সকালে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, চিফ হুইপ নুর-ই-আলম চৌধুরী, সাবেক নৌপবিহনমন্ত্রী শাজাহান খান, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা সভাস্থল পরিদর্শন করেন।
জানতে চাইলে মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব মানুষ প্রাণের টানে এই জনসভায় উপস্থিত হতে চায়। আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। জেলার পাঁচ উপজেলায় দুই হাজারের বেশি বাস এবং নৌপথে কিছু লঞ্চে লোকজন জনসভায় যাবে। তবে গাড়ির অভাবে অনেকে হয়তো যেতে পারবে না। ’
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন বলেন, ‘উদ্বোধনের দিন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের আয়োজনে জনসভাস্থলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। এতে অংশ নেবেন দেশের খ্যাতিমান শিল্পীরা। জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগে আনন্দ ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে। ’
পদ্মায় ভাসবে ৫০টি সুসজ্জিত নৌকা
প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে রং-বেরঙের বেলুন আর লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা দিয়ে সাজানো ৫০টি নৌকা আজ সকাল থেকেই পদ্মা সেতুর নিচে ভাসতে থাকবে। নৌকায় মাঝি ছাড়া থাকবে না কেউ। নৌকাগুলোর মাস্তুলে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নুর-ই-আলম চৌধুরী ও তাঁর বাবা ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরীর ছবি। পদ্মার পারের জেলেদের নিয়ে এই আয়োজন করেছে শিবচর পৌরসভা। নৌকাগুলো সাজিয়ে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী ঘাট এলাকার চরচান্দায় পদ্মার পারে রাখা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন নৌকাগুলো দেখতে গতকাল দর্শনার্থীরা ভিড় করছে পদ্মার পারে।
নৌকার মাঝি আয়নাল হাওলাদার বললেন, ‘কাল (আজ) সকালে এই ৫০টি নৌকা নিয়ে একযোগে পদ্মার বুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাব। প্রধানমন্ত্রীর আগমনে আমরা ভীষণ খুশি। তাঁর এই আগমন আমাদের পদ্মা পারের জেলেদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ’
বিমানবাহিনীর ফ্লাইং ডিসপ্লে
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে আজ শনিবার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এক মনোজ্ঞ ফ্লাইং ডিসপ্লের আয়োজন করেছে। আইএসপিআর জানায়, ৩১টি বিমান এবং হেলিকপ্টারের সমন্বয়ে এই ফ্লাইং ডিসপ্লে অনুষ্ঠিত হবে।
মাওয়ায় উত্সুক জনতা আর পর্যটকদের ভিড়
মাওয়ায় পদ্মা সেতু দেখতে গতকাল স্থানীয় ও দূর-দূরান্তের পর্যটকরা এখানে ভিড় করে। বাড়ি-ঘরের ফাঁকফোকর দিয়ে যতটুকু দেখা যায়, তাতেই আনন্দ তাদের। ঢাকার দোহারের আবু বকর সিদ্দিক। পেশায় শিক্ষক। টিভিতে সেতুর সাজসজ্জা দেখে তিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। গতকাল বিকেলে হাজির হন পদ্মার পারে।
গতকাল বিকেলে রুফটপ রেস্টুরেন্টগুলোতেও পর্যটকদের ভিড় দেখা যায়। ছাদে দাঁড়িয়ে সেতুকে পেছনে রেখে অনেককে ছবি তুলতে দেখা যায়। এদের একজন গাজীপুরের মনির হোসেন। উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার কারণে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই তিনি এক দিন আগেই চলে এসেছেন।
পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে নৌকার আদলে সাজানো হয়েছে গাড়ি।
মনির হোসেন বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে দৃঢ় মনোবল নিয়ে পদ্মা সেতু তৈরি করেছেন, তা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হতো না। তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলেই তা সম্ভব হয়েছে। নিজেদের টাকায় সেতু নির্মাণ করে তিনি বিশ্বের কাছে বাংলাদেশিদের সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেছেন। ’