দ্বোধন হতে যাওয়া পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতিতে বিভিন্নভাবে অবদান রাখবে বলে মনে করি। প্রথমত, পদ্মা সেতু আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে করেছি, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় করেছি। সে হিসেবে নিজস্ব সক্ষমতার পরিচায়ক এবং আত্ম মর্যাদার প্রতীক এই সেতু। দ্বিতীয়ত, আমাদের শেষ ভৌগোলিক যে বিভাজন ছিল, পদ্মা সেতু সেই সমস্যার সমাধান করেছে। সংযোজন স্থাপনকারী হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ একটা একীভূত অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হতে পারবে। আমরা যে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির কথা বলছি, পদ্মা সেতু সেদিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তৃতীয়ত, এ সেতুর ফলে আমাদের বিনিয়োগ, বিতরণ ও বিপণনে যে সাশ্রয় হবে, সেটা অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। আমরা আশা করছি বিনিয়োগ আকর্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিনিয়োগকারীরা সাশ্রয়ী সময়ে এবং সাশ্রয়ী ব্যয়ে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবেন।
সেতুর সুবাদে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে দেশের অন্য জেলাগুলোর সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
যার ফলশ্রুতিতে ভোক্তা, উৎপাদক ও উদ্যোক্তারা উপকৃত হবেন। এতে ভোক্তা ও উৎপাদকের জন্য সাশ্রয়ী হবে। চতুর্থত, পদ্মা সেতুকে কেবল মাত্র সেতু হিসেবে বিবেচনা করলে হবে না। এটা কেবল মাত্র যোগাযোগ করিডোরও না। এটাকে অর্থনৈতিক করিডোর হিসেবে চিন্তা করতে হবে। এই অর্থনৈতিক করিডোর আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক মূল কেন্দ্র রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলোকে যুক্ত করবে। পাশাপাশি উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। বিবিআইএন মোটরভেইকেল চুক্তির সুবাদে পদ্মা সেতু ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের মূল চালিকা শক্তি হবে।
এ ছাড়া এশিয়ান রেল ও সড়ক সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে সেখানেও পদ্মা সেতু একটা মূল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। পঞ্চমত, এই যোগাযোগ করিডোরকে অর্থনৈতিক করিডোরে উন্নীত করে দেশের জন্য সর্বোচ্চ কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাবার একটা সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা ট্রান্সপোর্ট কানেকটিভিটি, ইনভেস্টমেন্ট কানেকটিভিটি ও ট্রেড কানেকটিভিটির ত্রিমাত্রিক সংশ্লেষ করতে সক্ষম হবো। সেতু চালু হলে মোংলা ও পায়রাবন্দর আমাদের অর্থনীতির একটি মূল সঞ্চালক হিসেবে কাজ করবে। পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা পরীক্ষায় বলা হয়েছিল যে, সড়কের কারণে আমাদের ১.২৬ শতাংশ জিডিপিতে যোগ হবে, রেলের কারণে ১ শতাংশ জিডিপিতে যোগ হবে।
অর্থনীতিতে এই অবদান অর্জিত হবে যদি এই সড়ক করিডোরটাকে অর্থনৈতিক করিডোরে পরিণত করতে পারি। ষষ্ঠত, অর্থনৈতিক করিডোরে পরিণত করতে বেশ কিছু পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এরমধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ১৭টি স্পেশাল ইকোনোমিক জোনের পরকিল্পনা আছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ও পর্যটন শিল্প প্রতিষ্ঠা করারও পরিকল্পনা আছে। এগুলো ঘিরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসবে এবং বিভিন্ন সেবাখাত গড়ে উঠবে। এ সম্ভবনাগুলোকে কাজে লাগাতে হলে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে হবে। ফলে সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর আহরণ করতে পারবে এবং রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ২১টি জেলার মধ্যে ১৩টি জেলার গড় দারিদ্র্যসীমার নিচের জনসংখ্যা বাংলাদেশের গড়ের চেয়ে বেশি। এসব জেলা থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারে অংশগ্রহণও তুলনামূলকভাবে কম।
সেতুর ফলে এ অঞ্চলের জনগণের শ্রম বাজারে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ বাড়বে এবং জীবন মান উন্নত হবে। ভোক্তা-উৎপাদক-উদ্যোক্তা-সাধারণ জনগণ সবাই এই সেতুর কারণে লাভবান হবেন। সুতরাং একটা বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে হলে সমান্তরাল বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রাক্কলন করা হয়েছিল আমাদের জিডিপিতে যোগ হবে ২.২৬ শতাংশ, কর্মসংস্থান হবে সাড়ে ৭ লাখ মানুষের। যদি আমরা প্রয়োজনীয় কাজগুলো সময়মতো, সাশ্রয়ীভাবে ও সুশাসনের সঙ্গে বাস্তবায়িত করতে পারি তাহলেই পদ্মা সেতু থেকে জাতি-অর্থনীতির প্রত্যাশিত ইতিবাচক ফলাফল পাবে।