আজ সূর্যের সকাল, অপেক্ষা সমাপ্তির সকাল। আজ স্বপ্ন স্পর্শের দিন। অনেক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দেয়ার সময়। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণের সঙ্গে উত্তরের স্থায়ী মিতালি, চিরকালের সন্ধি। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবতার দিন আজ। এ প্রেক্ষাপটে পদ্মাপাড়ে বইছে প্রাণের উচ্ছ্বাস। সেই উৎসবের রং ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশে। কোটি মানুষের প্রতীক্ষার শেষ।
আজ শনিবার ঘড়ির কাঁটা যখন সকাল ১০টার ঘরে ঠিক তখনই মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর দুয়ার খুলে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেন। এর মাধ্যমে হয়ে গেল দেশের বড় এক স্বপ্নের বাস্তবায়ন। এরপর প্রথম টোল দিয়ে গাড়ি নিয়ে পদ্মা সেতু পার হয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচন এবং সুধী সমাবেশ হয়েছে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে। শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে সেতুর আরেকটি নামফলক ও ম্যুরাল-২ উন্মোচন শেষে দুপুর ১২টার দিকে কাঁঠালবাড়িতে জনসভায় শেখ হাসিনা।
সেতুর উদ্বোধন ঘিরে পদ্মার দুই প্রান্তের জেলা ও উপজেলাগুলোতে লেগেছে উৎসবের রং। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে সরকারের মন্ত্রী, এমপিসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা অনুষ্ঠানস্থলে গিয়েছেন। তাই এক্সপ্রেসওয়ের দুই প্রান্ত ও এর সংযোগ সড়কের কেন্দ্রস্থল রূপ পেয়েছে প্রচার-প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে। এক্সপ্রেসওয়ে ছাড়াও রাস্তা নির্মাণের কাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনী, সেতু বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তর ও এই অঞ্চলের নেতাকর্মীদের দেওয়া বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারে ছেয়ে গেছে আশপাশের উপজেলার বিভিন্ন রাস্তাঘাট,
হাটবাজার ও অলিগলি। সেতু নিয়ে আলোচনা চলছে চায়ের দোকান, হোটেল, সেলুন, সরকারি-বেসরকারি অফিস, ক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে। দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও চান ইতিহাসের সাক্ষী হতে।
মাওয়াপ্রান্তের সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন প্রায় ৫ হাজার সুধীজন। এ তালিকায় রয়েছেন মন্ত্রিসভার সদস্য, রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিক, নির্মাণ সহযোগী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা।
এদিকে পদ্মার দক্ষিণপাড় কাঁঠালবাড়ি ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ঘাটে শেষ জনসভার প্রস্তুতি। কয়েকদিন ধরে দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ নেতারাসহ সংশ্নিষ্টরা দফায় দফায় পরিদর্শন ও প্রস্তুতি বৈঠকসহ নানামুখী তৎপরতার মধ্য দিয়ে এই প্রস্তুতি শেষ করে এনেছেন।
জনসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা বক্তব্য দিয়েছেন।
জনসভার পরপরই শুরু হবে আতশবাজি উৎসব এবং বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পরে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পরবর্তী আরও পাঁচ দিন চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, ১০ লাখ লোকের অংশগ্রহণে ঐতিহাসিক এই জনসভায় দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলাসহ দেশের সব এলাকা ও প্রান্ত থেকে জনসমাগম ঘটবে।
এদিকে গতকাল শুক্রবার সকালে জনসভাস্থল পরিদর্শন করেছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম ও পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদ। এ সময় তাঁরা সংশ্নিষ্টদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন।
পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম বলেন, এই জনসভায় লাখ লাখ মানুষ অংশ নেবে এটা বলতে পারি কিন্তু কত লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করবে তা অনুমান করা সম্ভব নয়।
নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী এমন একটি কর্ম সম্পাদন করেছেন যেখানে তিনি সমগ্র পৃথিবীকে যুক্ত করে ফেলেছেন।
পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘আধুনিক বাংলাদেশের নবযাত্রা শুরু হবে আগামীকাল। আমরা এরই মধ্যে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মানুষকে জানিয়ে দিয়েছি কাল (আজ) পদ্মাপাড়ে আসা-যাওয়ার পথনকশা কেমন হবে। আমাদের নির্দেশনা লক্ষ্য করলে জনসভায় আসতে কোনো সমস্যা হবে না।’ আগত মানুষকে করোনা বিধিনিষেধ মানারও অনুরোধ জানান আইজি।
নিরাপত্তা বলয়: পদ্মার দুই প্রান্তে গড়ে তোলা হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয়। সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। হাইওয়ে পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, জেলা পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, নৌ পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদেরও সর্তক চোখ পদ্মা সেতুর উদ্বোধন আয়োজন ঘিরে। বিভিন্ন প্যাট্রলিং ছাড়াও আকাশপথে থাকছে র্যাবের হেলিকপ্টারের নজরদারি।
মুন্সীগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার আবদুল মোমেন বলেন, পদ্মার আশপাশে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন সড়কে বসানো হয়েছে তল্লাশি চৌকি।
এদিকে কাঁঠালবাড়ির জনসভার নিরাপত্তার জন্য মঞ্চের ভেতর ও বাইরে বসানো হয়েছে ৬টি ওয়াচ টাওয়ার। দেড় শতাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা। র্যাব, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট, সেনাসদস্য ও এসএসএফসহ নানা বাহিনীর তৎপরতা।
বিআইডব্লিউটিএর প্রস্তুতি: বিআইডব্লিউটিএর শিমুলিয়া নদীবন্দর কর্মকর্তা মো. সাহাদাত হোসেন জানান, সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মাওয়া থেকে বাংলাবাজার প্রান্তে ভিআইপিসহ সর্বসাধারণের যাতায়াতের সুবিধার্থে নতুন ৬টি নৌঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। নৌপথে নির্বিঘ্নে নিরাপদে সমাবেশে অংশ নেওয়ার লক্ষ্যে নদীতে আধুনিক মার্কা বয়া-বিকন স্থাপন করা হয়েছে। সমাবেশে আগত মানুষের নিরাপত্তার জন্য ৩০টি নৌযান প্রস্তুত রয়েছে। তিনি আরও জানান, সমাবেশে আগত মানুষের যাতায়াত সুবিধার জন্য দু’পাড়ের ফেরিঘাট এলাকা সংস্কারসহ নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন স্থান থেকে নৌপথে আগত মানুষের জন্য অতিরিক্ত পন্টুন স্থাপনসহ ৮টি নতুন অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ, সেনাবাহিনীসহ নিয়োজিত এসএসএফের চাহিদা অনুযায়ী শিমুলিয়া মাঝিকান্দি এবং বাংলাবাজারে ৩টি কন্ট্রোল রুম স্থাপনসহ ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে।
জনসভা ঘিরে সাজ সাজ রব: জাজিরা প্রান্তের কাঁঠালবাড়ির জনসভার মঞ্চ ও আশপাশের এলাকাজুড়ে এখন সাজ সাজ রব। বর্ণিলভাবে সাজানো হয়েছে গোটা এলাকা। রংবেরঙের ব্যানার, বেলুন, পতাকা, ফেস্টুন, তোরণ স্থাপন করা হয়েছে জনসভাস্থল ও আশপাশের সড়কে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য নৌকার সমারোহ। জনসভা শেষে আতশবাজি উৎসব ও বর্ণিল আলোকসজ্জার প্রস্তুতিও শেষ হয়েছে।
পদ্মা সেতুুর আদলে জনসভা মঞ্চ: পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত জনসভার জন্য পদ্মাপাড়ের প্রায় ১৫ একর এলাকা নান্দনিক করে গড়ে তোলা হয়েছে। বিশাল প্যান্ডেলের পাশাপাশি মূল মঞ্চকে দেওয়া হয়েছে পদ্মা সেতুর রূপ, সৃষ্টি করা হয়েছে পদ্মা নদীর আবহ। ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪০ ফুট প্রস্থের বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে মাঠের পূর্বদিকে। মঞ্চের সামনে রয়েছে ২০০ ফুট লম্বা ও আট ফুট প্রস্থের একটি প্রতীকী সেতু। ঠিক তার ওপরেই বসানো হয়েছে উদ্বোধনী মঞ্চ। মঞ্চের ঠিক সামনে পানিতে ভাসতে থাকতে দেখা যাবে ৬০ ফুট লম্বা একটি নৌকাসহ কয়েকটি ছোট ছোট নৌকা।
সভাস্থলে ৫০০টি অস্থায়ী শৌচাগার, ভিআইপিদের জন্য আরও ২২টি শৌচাগার, সুপেয় পানির লাইন, ২০ শয্যার একটি এবং ১০ শয্যার দুটিসহ মোট তিনটি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্র খোলা হয়েছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া থাকবে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা।
জনসভাস্থলে রয়েছে নারীদের আলাদা বসার ব্যবস্থা। দূরের দর্শকদের জন্য ২৬টি এলইডি মনিটর ও পাঁচ শতাধিক মাইকের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো তাঁদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভ্রাম্যমাণ মোবাইল টাওয়ার নির্মাণ করছে যোগাযোগ রক্ষার জন্য। ইন্টারনেট সুবিধার জন্যও নেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, যাতে গণমাধ্যমে সংবাদ সরাসরি প্রচার করতে বেগ পেতে না হয়।
মানুষ ছুটছে পদ্মাপাড়ে: পদ্মা সেতুর উদ্বোধনসহ বর্ণাঢ্য কর্মসূচিতে যোগ দিতে কেবল দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলা নয়, সারাদেশ থেকেও মানুষ আসতে শুরু করেছে পদ্মাপাড়ে। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সারাদেশের মানুষের আগমনে কাঁঠালবাড়িতেও দেখা গেছে উৎসবমুখর পরিবেশ। মানুষের ভিড়ে জনসভাস্থলের কাছের শিবচর উপজেলার পাচ্চর ও পৌর বাজারের আবাসিক হোটেলগুলোতে কোনো কক্ষ খালি নেই।
জনসভা মঞ্চের সামনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান এমপি বললেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ও জনসভা ঘিরে সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাস-আনন্দের যে বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে- সেটা অতীতে কখনই দেখা যায়নি। তাই এ উদ্বোধন ও একে ঘিরে সব অনুষ্ঠানমালা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে বলে তাঁদের প্রত্যাশা।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় আগত মানুষকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে জেলা প্রশাসন সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে।