স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে ৫৩ বছরে পা রেখেছি আমরা। স্বাধীনতা অর্জন বাঙালির জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত অধ্যায়। এই অর্জনের অর্থ যে কেবল একটি মুক্ত ভূখণ্ড কিংবা নতুন জনপদ, জীবনধারা সৃষ্টি করতে নতুন রাষ্ট্রের আয়োজন তা নয়; বরং স্বাধীনতা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি শব্দ। যার দ্বারা বোঝানো হয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে সার্বভৌম জাতি হিসেবে টিকে থাকার পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতাকে। যেখানে যুক্ত থাকবে সামাজিক-অর্থনৈতিক মুক্তি রাজনৈতিক অধিকার ব্যক্তি-ইচ্ছার পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা। পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার। একটি রাষ্ট্র যদি এই দায়িত্বসমূহকে সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়, তবেই তাকে স্বাধীন রাষ্ট্র বলা যাবে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথে সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করেছে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের এই দায়িত্বসমূহ পালনের অক্ষমতা। পাকিস্তান সরকার আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে পারেনি, অর্থনীতির বিস্তার ঘটাতে পারেনি। বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করেছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উত্তরণ হতে দেয়নি। এজন্য জনগণ ফুঁসে উঠেছিল। অস্ত্র ধরেছিল। রক্ত ঝরিয়েছিল। এবং স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল। বাঙালির মুক্তির স্বাদ এমনি এমনি আসেনি। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ সংগ্রাম সম্ভ্রম মৃত্যু লাঞ্ছনা আর চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে। এই বিজয় আমাদের দিয়েছে লাল-সবুজের পতাকা, একটি গর্বিত সার্বভৌমত্ব। ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার সেই দীপ্ত ঘোষণার মধ্য দিয়েই মূলত বাংলার নিপীড়িত ও বঞ্চিত জনগণ পেয়েছিল মুক্তির প্রত্যাশা।
স্বাধীনতাযুদ্ধের নেপথ্যে আমাদের চেতনা ছিল একটি সুখী সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়ে তোলা। এই সুখী দেশ গড়ে তুলতে যেমন প্রয়োজন অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক ভূরাজনৈতিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি অর্জন করা, তেমনি জরুরি একটি দক্ষ জনগোষ্ঠী ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগী হওয়া। কেননা অর্থনৈতিক সক্ষমতা আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারে, সামাজিক সক্ষমতা আমাদের সামাজিক ভিত্তিকে মজবুত করতে পারে কিন্তু সেই ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজন হয় একটি দক্ষ জনগোষ্ঠীর। আর দক্ষ জনগোষ্ঠী গঠনে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের কোনো বিকল্প নেই। স্বাধীনতার এই পাঁচ দশকে আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছি। বিশেষ করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে আমরা স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেছি, মেট্রোরেল নির্মাণ করেছি, কর্ণফুলী টানেল চালু করেছি অর্থাৎ অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এসব অবকাঠামোগত উন্নয়নে আমাদের নির্ভর করতে হয়েছে বহির্বিশ্বের ওপরে। কেননা এই সব ক্ষেত্রের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিসমূহ উৎপাদন করার সক্ষমতা আমাদের এখনো আসেনি, সেই প্রযুক্তিকে পরিচালনা করার মতো দক্ষ জনশক্তি আমাদের এখনো তৈরি হয়নি। এটা সত্য যে, আমরা ইতিমধ্যে নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে সাফল্যের অনেক উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছি; কিন্তু তাদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রের বৃহত্ উন্নয়ন নিশ্চিত করার মতো প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। তবে আশার কথা হচ্ছে, আমাদের বৃহত্ একটি জনগোষ্ঠী আছে। এই জনগোষ্ঠীকে যদি একটি জনশক্তিতে রূপান্তর করা যায়, তাহলে জাতির এগিয়ে যাওয়ার পথ আরো ত্বরান্বিত হবে। এজন্য প্রয়োজন একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা। যেখানে থাকবে জ্ঞানের বিকাশ ও চর্চার জন্য যথোপযুক্ত পরিবেশ। জ্ঞানকে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো সক্ষমতা। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে এ ব্যাপারে খুব বেশি উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আজকের নতুন প্রজন্মের মধ্যে আগামী দিনের বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তি ও সত্সাহস পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যার একটি বড় কারণ, এই প্রজন্ম বইবিমুখ হয়ে ঝুঁকে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে। ফলে শিশুকাল থেকেই তাদের মেধাভিত্তিক বিকাশের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে এবং বোধের জায়গাটা তৈরি হচ্ছে না। এই নতুন প্রজন্মকে যদি আমরা জাগ্রত করতে না পারি, তাদের বোধের জানালায় টোকা দিতে সক্ষম না হই, তবে আমাদের জাতীয় জীবনের সব সমৃদ্ধি ও অর্জন আগামী দিনে স্থবির হয়ে যাবে। তাই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে প্রথম ও প্রধান টার্গেট করতে হবে নতুন প্রজন্মকে। তবেই আমাদের সেই সুখী, সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলাদেশ গড়ে উঠবে এবং তা স্থায়িত্ব পাবে। তাই স্বাধীনতার ৫৩তম বার্ষিকীতে প্রত্যাশা থাকবে—একটি আধুনিক ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজকাঠামো তৈরিতে দেশের সব নাগরিক উদ্বুদ্ধ হয়ে সচেষ্টভাবে এগিয়ে আসা।