পদ্মা যেন প্রায় সমুদ্র। একেবারে ছোটবেলায় তো আর সমুদ্র দেখিনি। গোপালগঞ্জে দাদার বাড়ি যাওয়ার সময় পাড়ি দিতে হতো পদ্মা নদী। পাড়ি দিয়ে চলে যেতাম; কিন্তু মনের মধ্যে প্রবল হয়ে জেগে থাকত তার অক্ষয় রূপ। কারণ গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে পদ্মা পার হওয়াটাই যেন আসল ঘটনা। স্মৃতি থেকে অন্য সবকিছু মুছে গেলেও পদ্মাকে মুছে দেয় সাধ্য কার! তার সে কী বিশালতা! এপারে দাঁড়ালে ওপার দেখা যায় না। ওই যে গানে শুনেছি ‘কূল নাই, কিনার নাই, নাই সে দরিয়ার পাড়ি’, তার সঙ্গে পদ্মার স্মৃতিই যেন একাকার হয়ে আছে। এ যেন সেই দরিয়া, সেই অপার সমুদ্র।
পদ্মা আমরা পাড়ি দিতাম রাজবাড়ী থেকে ফেরিতে করে। দু-একবার স্পিডবোটেও গিয়েছি বলে মনে পড়ে। তবে ফেরিই ছিল আসল। পদ্মা পাড়ি দেওয়া কি এতই সহজ! বাংলাদেশে সব নদীর রানী সে। তার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে, দেবীর দর্শণার্থীর মতো আকুল হয়ে দীর্ঘ লাইনে ধীরে ধীরে এগোতে হবে, তবেই না মুক্তি। আবার ফেরিতে উঠেও কি যাত্রা এত দ্রুত শেষ হয়! তরঙ্গে তরঙ্গে মনের মধ্যে পদ্মার ছাপ গভীর হয়ে উঠতে থাকে। আর পদ্মার সঙ্গে মিলমিশে থাকে জেলেদের ইলিশ ধরার আনন্দ।
দীর্ঘ পথে পদ্মা মর্মে মর্মে বুঝিয়ে দেয় ওর অস্তিত্ব। বুঝিয়ে দেয়, সে আছে সৌন্দর্যে, বিশালত্বে, আবেগে, বাংলাদেশের মূল ধমনি হয়ে, আমাদের জীবনযাত্রায়। বাংলাদেশের গহন থেকে উঠে এসে পদ্মা তার তীব্র স্রোত নিয়ে ঢুকে গেছে আমাদের জীবনের গভীরে।
সেই পদ্মা নদীর দুই পাড় এবার যুক্ত হলো সেতুবন্ধে। ভারতীয় পুরানের কাহিনিতে সমুদ্রের অতল বুকে অসাধ্য এক সেতু গড়ে তুলেছিলেন রাম, সীতাকে উদ্ধারের জন্য। পদ্মা সেতুর মধ্যেও যেন লুকিয়ে আছে তার এক প্রতীকী তাৎপর্য। পদ্মার প্রকৃতির কারণে এই সেতু গড়ে তোলা ছিল দুঃসাধ্য। আর সেতুটি তো দক্ষিণবঙ্গের বিপুল জনপদকে বিচ্ছিন্নতা থেকে উদ্ধারের এক পরম পথ। পদ্মা সেতু রচনায় যে অনমনীয় নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থির প্রতিজ্ঞায় বীরের মতো সেটা দিয়ে এসেছেন। একদিন যখন তিনি থাকবেন না, এই সেতু থাকবে তাঁর দৃঢ়সংকল্পের উদাহরণ হয়ে, বাংলাদেশের অসম্ভব প্রাণশক্তির এক নিদর্শন হয়ে।এই সেতুর গড়ে ওঠার পথে পদে পদে ছিল বাধা। প্রথমে ছিল প্রকল্পটি থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়া। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘নিজেদের টাকা দিয়েই আমরা নিজেদের এই সেতু গড়ে তুলব।’ প্রথমে শুনে মনে হয়েছিল, এ একটা অসম্ভব ভাবনা। অনেকেই হাহাকার করে উঠেছিলেন। বলেছিলেন নানা আশঙ্কার কথা। নানা রকমের গুজবে বাতাস ভারি হয়ে গিয়েছিল। এত বড় একটি প্রকল্প যে নিজেদের টাকায় করা সম্ভব, এই অটল আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রায় একাকী এগিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা। অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালেন। পদ্মা সেতু সম্ভবত তাঁর শ্রেষ্ঠতম অবদান, এই বঙ্গবাসীর জন্য। মানুষ নশ্বর; কিন্তু এ সেতুটি তাঁর স্মৃতি জাগিয়ে রাখবে। সব বাধা পেরিয়ে বাংলাদেশের নিজেরই আর্থিক সামর্থ্যে যে এটি হতে পারল, সে এক চমকপ্রদ ঘটনা। পদ্মা সেতু বাঙালির ক্ষয় হতে থাকা সাহস আবার আমাদের বুকে ফিরিয়ে দিল। পদ্মা সেতু ভবিষ্যতে আমাদের কী দেবে, সেটা পরের কথা। আপাতত আমাদের হারিয়ে যাওয়া সাহস ফিরিয়ে দেওয়াই এর সবচেয়ে বড় কীর্তি।
শেখ হাসিনা এ অবধি অনেক দুঃসহ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন। ১৯৭৫ সালের নৃশংস এক হত্যাকাণ্ডে হারিয়েছেন পরিবারের প্রায় সবাইকে। তাঁর প্রাণসংহারের চেষ্টা হয়েছে বারবার। একাধিকবার কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচেছেন। সেসব অন্ধকার তাঁকে ভেতর থেকে ন্যুব্জ করে ফেলারই কথা ছিল হয়তো। কিন্তু প্রতিবার তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। এগিয়ে গেছেন প্রচণ্ড ইতিবাচক এক সংকল্প নিয়ে। পদ্মা সেতু তাঁর অনমনীয় সংকল্পের এক অমোঘ চিহ্ন।
বলছিলাম ভবিষ্যতের কথা। সেসব অর্থনীতিবিদ আর বিশেষজ্ঞদের বিষয়। তবে আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাদেশের মতো নদীবহুল দেশে প্রতিটি সেতুই অসম্ভব লাভজনক হয়েছে। মানুষের জন্য, দেশের জন্য। শুধু লাভের হিসাবই বা এখানে আসবে কেন? একেকটি সেতু একেক অঞ্চলের জনপদকে যেভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তার হিসাব শুধু নগদ টাকায় গোনা যাবে না। উত্তরাঞ্চলের প্রতিবছরের করুণ দুর্ভিক্ষ যে কর্পূরের মতো উবে গেল, তার পেছনে এক যমুনা সেতুর ভূমিকাই অসামান্য। তাই পদ্মা সেতুকে ঘিরে শুধু এ নদীটির দুই পাড়ের মানুষদেরই নয়, সারা দেশবাসীরই বিপুল উত্তেজনা। পদ্মা সেতুর স্বপ্নের মধ্যে যেন সারাদেশের মানুষের বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন একাকার হয়ে মিশে আছে।দক্ষিণবঙ্গের মানুষের স্বপ্ন, এই সেতু আসছে তাদের উন্নততর জীবনের দিকে পাড়ি দেওয়ার একটি বাহন হয়ে। এই সেতুর ঘটকালিতে দুই পাড়ের ভূখণ্ডের পরিণয়ে সারাদেশের মানুষই যেন বরযাত্রী।
পদ্মার দুই পাড় আলিঙ্গন করুক। সমস্ত পথে দেশের মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধ গড়ে উঠুক। কার সাধ্য বাংলাদেশকে রোখে!