গতকাল রাজধানী ঢাকার দুটো স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রথমত, মহাখালীতে সাততলা বস্তিতে আগুন লেগে বেশ কয়েকটি ঘর পুড়ে গেছে। দ্বিতীয় কাপ্তানবাজারের জয়কালী মন্দিরসংলগ্ন সুইপার কলোনিতে আগুন লেগেছে, যেখানে দগ্ধ হয়েছেন চার জন। এ ধরনের দুর্ঘটনা বলতে গেলে লেগেই আছে। বিগত কয়েক বছরে দেশে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে। এতে ভারী হচ্ছে মানুষের মৃত্যুর মিছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো ছিল—২০১০ সালের নিমতলী, ২০১২ সালে তাজরীন গার্মেন্টস, ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টা, ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ফ্যাক্টরি, ২০১৯ সালে এফআর টাওয়ার ইত্যাদি। অন্য দিকে বিস্ফোরণের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে—২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জ মসজিদে গ্যাস লিকেজ, ২০২১ সালে ঢাকার মগবাজারে গ্যাস বিস্ফোরণ ও ২০২২ সালে সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোর অক্সিজেন পার-অক্সাইডজনিত বিস্ফোরণ ও প্রাণহানি জনগণকে আতঙ্কিত করেছে। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলেও ঘটেছে একাধিক অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণের ঘটনা। অতি সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কদম রসুলের সীমা রি-রোলিং মিল, ঢাকার সায়েন্সল্যাবের সন্নিকটে শিরিন ম্যানশন ও সর্বশেষ গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারের নর্থসাউথ রোডের ১৮০/১ হোল্ডিংয়ের বিস্ফোরণ সাধারণ নাগরিকদের করেছে শিহরিত। সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণের কারণ ভিন্নতর যদিও, এর ধ্বংসাত্মক ব্যাপ্তি প্রকট। তবে রাজধানীতে পরপর দুটি বিস্ফোরণ রাজধানীতে বসবাসের ভয়াবহতার অত্যন্ত রূঢ় বাস্তবতাকে স্পষ্ট করেছে। আমার মতে, অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষাগ্রহণ ও সতর্ক না হওয়া এবং অন্যান্য তদন্তের সুপারিশগুলো পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়াই এসব বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সম্প্রতি যে দুটি বিস্ফোরণ ঘটেছে, তাতে দেখা যায় উভয়টিই বাণিজ্যিক ভবন, যার মিশ্র ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ একই ভবনের মধ্যে আছে বাণিজ্যিক ব্যবহার, খাবার রেস্টুরেন্ট ও আবাসস্থল. যার ‘ডেজিগনেটেড ইউজ’ পরস্পরবিরোধী। একটি আবাসিক ভবনে যদি পরস্পরবিরোধী ব্যবহার থাকে, তাহলে তা জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সবসময় হুমকিস্বরূপ । নগরায়ণ প্রক্রিয়ায় এ ধরনের মিশ্র ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। তবে এক্ষেত্রে কিছু বেসিক নিয়মকানুন আছে, সেগুলো সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না বলে এ ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে সাততলা ভবনে যে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার নিচের দুটো তলায় ছিল স্যানিটারি ও গৃহস্থালিসামগ্রীর বেশ কয়েকটি দোকান, তার ওপরে ছিল ‘ক্যাফে কুইন’ নামের হোটেল, বেইজমেন্টে ছিল ‘বাংলাদেশ স্যানিটারি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ১ হাজার ৮০০ স্কয়ার ফিটের এ বেইজমেন্টটি ছিল সম্পূর্ণটাই কাচ দিয়ে ঘেরা, সেখানে ছিল না কোনো ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা। বরং বড় দুটি এসির মাধ্যমে ঠান্ডা রাখা হতো দোকানটি। এসব ভবনে থাকে তিতাসের গ্যাস লাইন, এলপিজি গ্যাস, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র, স্যুয়ারেজের লাইনসহ স্যুয়ারেজের সেফটি ট্যাংক। স্যুয়ারেজের এই ব্যবস্থায় জৈবিক পদার্থের পচনের ফলে ‘স্যুয়ার গ্যাস’ তথা হাইড্রোজেন সালফাইড, অ্যামোনিয়া গ্যাসসহ কিছু গ্যাস উত্পন্ন হয়। এছাড়াও স্যুয়ারেজ সিস্টেমে উত্পন্ন হয় ভয়াবহ মিথেন গ্যাস। জমে থাকা এই গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের ঘটনাকে ‘কনফাইন্ড স্পেস এক্সপ্লোসন’ বলে। বদ্ধ জায়গায় গ্যাস জমে বাতাসের এক্সপ্লোসিভ মিক্সার তৈরির মাধ্যমেও অনেক সময় ম্যাসিভ বিস্ফোরণ হতে পারে। এছাড়াও তিতাসের গ্যাস লিক, এলপিজির গ্যাস লিক কিংবা এসির রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার কারণে গ্যাস জমা, স্যুয়ারেজের জমে থাকা বায়োগ্যাস বের না হতে পারলে এ গ্যাস বিভিন্ন স্থানে জমতে পারে। উপরন্তু ভবন কোড না মেনে ভবন নির্মাণ ও এর তদারকির অভাবও বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। অধুনা বিক্ষিপ্তভাবে রাজধানীতে স্যুয়ারেজের সেফটি ট্যাংকের গ্যাস বের হওয়ার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয় না, এমনকি সেফটি ট্যাংকের ওপরেই ইমারত নির্মাণ করা হচ্ছে। ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা না থাকায় চাপের কারণে আবদ্ধ জায়গায় স্বাভাবিক মাত্রায় থেকে অধিক মাত্রায় গ্যাস জমা থাকলে চাপের প্রভাবে লিকের কারণে পরবর্তী সময় যে কেনো বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ কিংবা দেয়াশলাই থেকে বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে।
উপরিউক্ত ধরনের বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের জন্য নগর বিশেষজ্ঞরা অপরিকল্পিত নগরায়ণকেই মূলত দায়ী করেন। নগরায়ণে গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের লাইনও পরিকল্পিতভাবে করা হয়নি। এছাড়াও বিভিন্ন সময় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের জন্য দাহ্য পদার্থ বহন ও মজুতের তদারকির দুর্বলতাও দায়ী। এজন্য ভবনমালিক ও ব্যবহারকারীকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। চিন্তা করতে হবে তার ভবন কিংবা যেখানে সে বাস করছে, সেটা কোনো ‘গ্যাস বম’-এর ঝুঁকি আছে কি না, থাকলে তা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বোপরি সেবাদান প্রতিষ্ঠান—তন্মধ্যে তিতাস গ্যাস, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি ও স্যুয়ারেজ সার্ভিসসহ অন্যান্য সেবার ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনকেও নিয়মিত তদারক করা প্রয়োজন যাতে এ ধরনের কোন বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড না ঘটতে পারে। রাজউক শুধু ভবন নির্মাণে অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠান, বরং ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের নির্দেশনাগুলো সঠিকভাবে মেনে ভবন নির্মাণ ও পরবর্তী সময়ে কোনো টেম্পারিং করে ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করা হয়েছে কি না, সময় সময় তা তদারকি করা প্রয়োজন। অধুনা যানবাহনে বিপুলসংখ্যক গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহৃত হচ্ছে যা এক একটি ‘চলন্ত বোমা’। আমরা নিজেরাও ঘরে-বাইরে বোমার সঙ্গে বাস করছি। আরামের জন্য লাগানো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটিও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মাঝে মাঝে দানবীয় আচরণ করছে। কলকারখানার বয়লার কিংবা রাসায়নিক পদার্থ সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হয়ে উঠছে ‘ভয়ংকর মিসাইল’। তাজা প্রাণের অকালমৃত্যু এবং এর ভয়বহতা রোধকল্পে সর্বগ্রাসী এই ভয়াবহ বোমাসদৃশ পদার্থের রক্ষণাবেক্ষণে সংশ্লিষ্ট সবার আরো বেশি সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশিত।
এই ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সঠিকভাবে অ্যাড্রেস করা হলে দানবীয় এ ধরনের বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা হ্রাস করা যেতে পারে : ১. বাসা/যানবাহনের সিলিন্ডারে ব্লাস্টিং ক্যাপাসিটি ও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার নিয়মিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি ও রিটেস্টের ব্যবস্থা; ২. গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনের সঙ্গে জড়িত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্যাসলাইন রক্ষণাবেক্ষণে তদারকি ও গ্রাহকসংখ্যার প্রয়োজনীয় ডাটাবেজ তৈরি ৩) গ্যাস লিকেজজনিত সাবধানতা অবলম্বনের জন্য মারক্যাপটান ব্যবহার করা যেতে পারে—যা উন্নত বিশ্বে প্রায় ১৪০ বছর আগে থেকে ব্যবহার করছে এবং এর আইনি বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে; ৪. পুরোনো গ্যাস লাইন, গ্যাস রাইজারগুলো শনাক্ত, মেরামত বা প্রতিস্থাপন এবং নিয়মিতভাবে সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী কর্তৃপক্ষের পরীক্ষার ব্যবস্থা ৫. বিস্ফোরক, ও দাহ্য পদার্থ, ব্যবহার, পরিবহন ও সঠিকভাবে সংরক্ষণে সতর্কতা এবং এদের ব্যবহার ও সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষজ্ঞদের নিয়োজিত করা; ৫. বিভিন্ন সেবা সংস্থা (গ্যাস, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, পানি, ও স্যুয়ারেজ সার্ভিস ইত্যাদি) ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ সার্টিফিকেট প্রদানের মাধ্যমে তা তদারকি ও ডাটাবেজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা; ৬. বিল্ডিং কোড মেনে বিল্ডিং নির্মাণ করা, যাতে ঘরে প্রয়োজনীয় আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে; ৭. ভবনের বেজমেন্ট বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার না করা; ৮. আবাসিক এলাকায় বিস্ফোরণ ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারে অনুমতি না দেওয়া ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সব সময় মনিটরিং করা ৯. আবাসিক ভবনে/শিল্প কারখানায় স্বয়ংক্রিয় ফায়ার অ্যালার্ম রাখা এবং এগুলো সারা বছর ব্যবহার উপযোগ্য/সক্রিয় রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া এবং বছরে এক-দুই বার ফায়ার ড্রিল করার ব্যবস্থা; ১০) অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্তে তদারকি সংস্থাগুলোর সক্রিয়তা বৃদ্ধি করা; ১১) দীর্ঘ সময় পর বসতবাড়িতে ফিরলে দরজা, জানালা প্রথমে খুলতে হবে, যেন গ্যাস জমা থাকলে তা বের হতে পারে। এরপর বৈদ্যুতিক সুইচ দেওয়া উচিত, এ প্রসঙ্গে জনগণকে সচেতনতার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ গ্রহণ।
ভবন নির্মাণে অনিয়ম, অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ ও তদারকির অভাবসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও সচেতনতার অভাবেও এসব বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কাকে বিশেষজ্ঞরা উড়িয়ে দেন না। সেবা সংস্থাগুলোর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও মেরামত এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতনতার মাধ্যমে এসব দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব।