একটি গল্প শেষ হলো। আরেকটি গল্পের শুরু হবে আজ। নতুন গল্পটি আশার, সম্ভাবনার। পুরনো গল্পটি ত্যাগের, সাহসের, নির্মাণের।
পুরনো গল্পটির গহিনে কুবের মাঝি, কপিলা, ধনঞ্জয়, রসুলদের দুর্দশার বলে খেদ ছিল লেখকের। ক্ষুধা, দারিদ্র্যের সংগ্রামে এই মানুষগুলোর একা লড়ার সেই গল্পে ভয়াল পদ্মার পারে ঈশ্বরকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। নতুন গল্পটি ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র কাল পেরিয়ে পদ্মা সেতুতে গাড়ি চালানোর সময়ের। আর তার আনুষ্ঠানিক শুরু আজ থেকে।
৬.১৫ কিলোমিটারের একটি সেতু দেশের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ এলাকাকে সরাসরি স্থলপথে যুক্ত করবে। প্রত্যাশা, সৌভাগ্যের ডালা নিয়ে দখিনের দুয়ার খুলুক আজ। সর্বনাশা পদ্মা হয়ে উঠুক সম্ভাবনার প্রতীক। আজ থেকে আর পদ্মা ‘এপার-ওপার’ বলে কিছু থাকবে না। আজ শনিবার সকাল ১০টায় ঘটতে যাচ্ছে সেই মিলন।
পদ্মা সেতু শুধু ভৌগোলিক সীমানার ঐক্যের বন্ধন হিসেবে কাজ করবে না। তিন জেলার ওপর অবস্থিত এই সেতু প্রকল্প সরাসরি ২১ জেলাকে যুক্ত করলেও এর সুবিধা পাবে সারা দেশের মানুষ। বদল আসবে অর্থনীতিতে। সচল হবে দক্ষিণের শিল্পের চাকা। গতি বাড়বে মোংলা বন্দরের। গড়ে উঠবে পায়রা বন্দর। মানুষের জীবন হবে স্বাচ্ছন্দ্যময়। বাঁচবে সময়, বাড়বে আয়, বাড়বে জিডিপি। ফেরির উত্কণ্ঠার ইতি ঘটবে দ্রুত।
পরীক্ষা ছিল অনেক
পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগ সরকার আর দেশের জন্য ছিল এক কঠিন পরীক্ষার নাম। প্রথমে অর্থের জোগান দেওয়া। তারপর ঠিকাদারদের নিয়ে আসা। নিজের টাকায় সেতু! ঠিকাদারদের আশ্বস্ত হতেও সময় লাগল।
সেতুর প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল ঠিকাদারদের কাজে আগ্রহী করা। এটা না হলে বাকি চ্যালেঞ্জ তো মোকাবেলাই করতে পারব না। ঠিকাদাররা বিশ্বাস করতে পারছিল না যে আমরা তাদের এত টাকা দিয়ে কাজ করাতে পারব। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের কাজ। যদি ঠিকাদারদের আস্থা না থাকে তাহলে তারা আসবে না। ’
নির্মাণকাজের ধাপে ধাপেও ছিল নানা পরীক্ষা। সেতুর খুঁটি বসাতে পাইলিং করতে গিয়ে মাওয়ায় শক্ত মাটি পাওয়া যাচ্ছিল না। এতে বিপাকে পড়েন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে কাজ থামানো হয়নি। জাজিরা প্রান্ত থেকে পাইলিং শুরু করা হয়। আর মাওয়া প্রান্তের সমাধান খুঁজতে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। দেশি-বিদেশি পরামর্শকদের কাছ থেকে মেলে সমাধান। নকশা পরিবর্তন করে ছয়টির পরিবর্তে সাতটি করে পাইলিং করা হয় ১৪টি খুঁটিতে।
দক্ষিণে দিনবদলের হাওয়া
পদ্মা সেতু দক্ষিণের মানুষের ভাগ্য ফেরাবে বলে বিশ্বাস করে ওই অঞ্চলের মানুষজনও। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের বন্ধন তৈরি করবে এই সেতু। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উদ্যোক্তারা যেখানে ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে দুই দিনেও পণ্য পৌঁছাতে পারতেন না, পদ্মা সেতু হওয়ায় চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই এসব অঞ্চল থেকে ঢাকায় পণ্য পাঠাতে পারবেন। কর্মসংস্থান বাড়বে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে দেশের মানুষ।
পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ২.৩০ শতাংশ। আর দেশের জিডিপি বাড়বে ১.২৬ শতাংশ। বাড়তি সুবিধা পাবেন রাজধানী ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা।
এখন মোংলা বন্দর থেকে ঢাকায় পণ্য আনতে সময় লাগবে তিন ঘণ্টা। আগে লাগত আট থেকে ৯ ঘণ্টা। মোংলা থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে আগে লাগত ১৪ ঘণ্টা। সেতুর কারণে তা কমে হবে সাত-আট ঘণ্টা। সব মিলিয়ে ১২ ঘণ্টা সময় এগিয়ে থাকবেন ব্যবসায়ীরা।
পদ্মা সেতু চালু হলে মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানি বাড়বে বলে মনে করছেন নিট পোশাক খাতের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, পোশাক খাতের জন্য মোংলা বন্দর বেশি উপযোগী হবে। প্রতি কনটেইনারে চার-পাঁচ হাজার টাকা পরিবহন খরচ কমবে।
ফেরি না পাওয়া, বৈরী আবহাওয়ার মতো কারণে মাদারীপুরের কলাই শাক, শরীয়তপুরের সবজি, ফরিদপুরের খেজুরের রস, বরিশাল, পটুয়াখালীর তরমুজ, বাঙ্গি, আমড়াসহ শত শত কৃষিপণ্য ঘাটে পচত। কৃষকরা পেতেন না ন্যায্য দাম। আজ দক্ষিণের কৃষিতে আলো ফিরবে। কৃষক পাবেন ন্যায্য দাম।
ঢাকার কারওয়ান বাজারের সবজি ব্যবসায়ী শ্যামল মণ্ডল জানান, পদ্মার ওপারের জেলাগুলো থেকে অনেক ধরনের সবজি ও ফল ঢাকায় আসে। মাঝেমধ্যে ফেরির সংকটের কারণে সঠিক সময়ে কৃষক পণ্য পাঠাতে পারেন না। এ কারণে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়।
অ্যাম্বুল্যান্সের নিয়মিত চালক শাহজাহান সরদার। একাধিকবার পদ্মায় ফেরি পার হওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থেকে রোগীর মৃত্যু দেখেছেন তিনি। দেখেছেন স্বজন হারানোর বেদনার কষ্ট।
শাহজাহান সরদার বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়া মানে চিকিত্সার অভাবে মরার হাত থেকে বাঁচা। এত দিন লঞ্চ, ট্রলার আর ফেরি ছিল পদ্মা পার হওয়ার উপায়। অ্যাম্বুল্যান্সে মুমূর্ষু কোনো রোগীকে ঢাকায় নিতে ফেরির কোনো বিকল্প ছিল না। আর সেই ফেরি পেতে ভোগান্তির শেষ ছিল না। আজ যেন মুক্তি মিলল।