মার্চ ২০২৩। কাগজে দুই দেশের সইসাবুদ হলো, জন্ম নিলো ‘সৌদি-ইরান চুক্তি’। সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চুক্তি। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যে পশ্চিম এশিয়ার বুক ঠেসে বসে থাকা এতগুলো বছরের অশান্তির বেলুনটিতে বড়ো একটি ছিদ্র হয়ে গেল। ‘ভালো লাগছে, ফিল গুড’-এর মহাপ্লাবনে উত্সাহিত পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলো পুরোনো বিবাদের মীমাংসায় ও ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে এখন মহাব্যস্ত।
অতীতে, মার্চ মাসে একাধিক নৃশংসতা ঘটেছে। যেমন :২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, ২৪ মার্চ ১৯৯৯ সালে ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণা করে ন্যাটোর বিমানবহর বেলগ্রেডের (সার্বিয়ার রাজধানী) আকাশ থেকে ননস্টপ ৭৮ দিন বোমাবর্ষণ করে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছিল না। বলাই বাহুল্য, অসংখ্য নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু নিহত ও আহত হয়েছিল। যাহোক, ইইউ এখন সার্বিয়াকে পুরোনো দুঃখ-দুর্দশা ভুলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, সার্বিয়া বলছে যে, ভুলে যেতে পারছে না।
১৯ মার্চ ২০১১ সালে সম্মিলিত পশ্চিম তার সামরিক শক্তিবল নিয়ে লিবিয়ার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। চিরায়ত মিথ্যা অজুহাত ছিল যে, গাদ্দাফির সামরিক বিমানবহর নিরীহ অসামরিক ব্যক্তিদের ওপরে বোমাবর্ষণ করছে এবং নিরুপায় নারীদের ধর্ষণে উত্সাহিত করতে জোয়ানদের মধ্যে ‘ভায়াগ্রা’ বণ্টন করছে। গাদ্দাফির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে মার্কিন বৈদেশিক মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলেন :‘আমরা এলাম, আমরা দেখলাম, তিনি মারা গেলেন।
আরেকটি ছিল ২০ মার্চ ২০০৩ সালে গণহত্যা অস্ত্রের ভান্ডার রয়েছে নামক নির্জলা মিথ্যা দোহাই দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণ ও দখলের নিষ্ঠুর হিংস্র ঘটনা। এই যুদ্ধে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ ইরাকি নিহত হন, মার্কিন সেনা নিহতের সংখ্যা ৫ হাজারেরও কম।
২০০৩ সালের ১৯-২০ মার্চে, যুক্তরাজ্য এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের নতুন সদস্য দেশগুলোকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাগদাদে বেদম বোমাবর্ষণ শুরু করে। প্যারিস ও বার্লিন বিরোধিতা করে। চীন ও রাশিয়া তীব্রভাবে যুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তারা কূটনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহ ও সাড়া দেওয়ার প্রক্রিয়াকে সমন্বিত করা শুরু করে।
২০০৩ সালে এবং ২০১১ সালে রাশিয়া ও চীন সদৃশ ভোট প্যাটার্ন অবলম্বন করে। নিরাপত্তা পরিষদে দুই দেশের এই সমন্বিত সহযোগিতা মস্কো ও চীনকে উত্সাহিত করে, পরস্পরকে কাছে নিয়ে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের ভেঙে তছনছ করে দেওয়া ইরাক আক্রমণ ও দখলের ফলস্বরূপ সন্ত্রাসের দ্রুত বিস্তার, আঞ্চলিক নৈরাজ্য, মার্কিন ক্ষমতার হ্রাস, পরবর্তী বছরগুলোতে আল-কায়েদা, আইএস-আইসিসের আবির্ভাব ইত্যাদি সব মিলিয়ে ভয়াবহ এক বিশ্ব পরিস্থিতির জন্ম হয়! ফলে, মালটিপোলারিটি বা বহুমেরুত্ব নামক স্প্রিংটি মুক্ত হয়। চীন ও রাশিয়া জাতিসংঘের চার্টার অনুযায়ী প্রকৃত বহুমেরুত্বের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।
বিশ বছর পরে, যুক্তরাষ্ট্রকে ইরাক যুদ্ধের চরম ফলাফলের মুখোমুখি হতে হচ্ছে!
ইরাক আক্রমণের ঠিক বিশ বছর পরে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের তিন দিনের রাষ্ট্রীয় ভ্রমণে মস্কো যাওয়ার প্রোগ্রাম কাকতালীয় ছিল কি না কে জানে! তবে আফ্রিকার ২০ বিলিয়ন ডলারেরও অধিক বকেয়া ঋণ বাতিল আদেশের জন্য পুতিন এই মুহূর্তটিই বেছে নেন। শি-পুতিন সামিট মিটিং যে চিরায়ত দ্বিপাক্ষিক জ্বালানি সম্পর্ককে ছাড়িয়ে আরো বিভিন্ন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে সমন্বিত বিরাট কিছু হতে যাচ্ছে, সেটি অনুমান করা যাচ্ছিল। কারণ, গত দুই দশক ধরে রুশ-চীন স্ট্র্যাটেজিসমূহ পরস্পরগ্রন্থিত হয়ে গেছে।
শি-পুতিন সামিট মিটিংয়ে শির আগমন রোধ করা যায় না? চেষ্টা করা যাক তবে? ১৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ কোর্ট (আইসিসি) পুতিন ও রুশ শিশু অধিকার-সম্পর্কিত কমিশনার মারিয়া লভোভা-বেলোভা-র বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তাদের অপরাধ কী কোর্ট—যুদ্ধ/কমব্যাট এলাকা থেকে মস্কো যে অসামরিকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা নেয় তার বরাত দিয়ে বলে যে তারা ‘জোরপূর্বক জনসমষ্টিকে স্থানান্তর’ করার প্রয়াস পেয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। আইসিসি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০২ সালে। ভারি চমকপ্রদ যে, ২০০৩ সালের অবৈধ ইরাক হামলার সাক্ষী সারা বিশ্ব, আইসিসি-ও, অথচ পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে যুক্তরাষ্ট্রের ‘শক অ্যান্ড ও’ প্রদর্শনের ২০তম বার্ষিকীর প্রাক্কালে! জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বা সাধারণ পরিষদের নথিপত্রে প্রসঙ্গটির উল্লেখ নেই! আইসিসিকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির প্রেরণা কে দেয়? ওয়াশিংটন ও লন্ডন উভয়েই স্বীকার করেছে যে, হামলাটি অবৈধ ছিল (১৯-৩-২৩)। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ও ব্যর্থ হয়েছে। আইসিসি-কে বিশ্বজন কি নজরে দেখবে অনুমান করা যায়? তবে সম্মিলিত পশ্চিমের জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানাটি ছিল পাবলিসিটি স্টান্ট।
পুতিনের বিরুদ্ধে তীব্র বিরাগ প্রকাশক আরেকটি ঘটনা ঘটে। গত এক বছর ধরে কৃষ্ণসাগরে মার্কিন গ্লোবাল হক ড্রোনের আনাগোনা ছিল নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু ১৪ মার্চ ক্রিমিয়া উপদ্বীপের কাছাকাছি ‘অফ-লিমিট’ এলাকায় টপ সিক্রেট মিশনে মার্কিন এমকিউ-৯ রিপার ড্রোনকে পাঠানো হয়। ঘটনাক্রমে মানুষবিহীন যানটির ‘ট্রান্সপন্ডার’ অফ ছিল। রুশদের দুটো ‘এসইউ-২৭’ ফাইটার ধাওয়া করে সোজা রিপারের ওপরে উঠে যায় এবং ছিপি খুলে রিপারকে জ্বালানি ঢেলে ঢেলে গোসল করিয়ে দেয়। তাতে করে দুটো কাজ হওয়ার কথা; ১) রিপারের সেন্সরগুলো কানা হয়ে যাবে, ২) জ্বালানির ভারে রিপারের ভারসাম্য নষ্ট হবে। যাহোক, কারণ যা-ই হোক তবে বত্রিশ মিলিয়ন ডলারের রিপারটি কৃষ্ণসাগরের অতলে ধসে পড়ে।
নির্লিপ্ত পুতিন ১৯ মার্চ প্রথমে দনবাসে যান, সেখান থেকে হেলিকপ্টারে চেপে চলে যান ‘মারিউপল’-এ। নিজে গাড়ি চালিয়ে মারিউপলের এখানে-সেখানে যান, লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। এই সেই মারিউপল, যেখানকার স্টিল কারখানার বেইজমেন্টে ন্যাটোর অপারেটিভরা ও আজব ব্রিগেড পরাজিত হয়েছিল।
২০ মার্চ সোমবার শি জিনপিং তিন দিনের ভ্রমণে মস্কো আসেন। দুই প্রেসিডেন্ট সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে একান্তে ঘরোয়াভাবে আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে পুতিন প্রেসিডেন্ট শি-কে লিমোজিন পর্যন্ত এগিয়ে দেন, গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা হয়, কথা শেষে করমর্দন করে বিদায় নেন তারা।
শি-পুতিন সামিটে আলোচনার বিষয় কী হবে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে দুই প্রেসিডেন্ট দুটো ‘অপ-এড’ লেখেন। পুতিন লেখেন ‘দুই দেশের ভবিষ্যৎ পার্টনারশিপ’ নিয়ে, প্রকাশিত হয় চীনের ‘পিপলস ডেইলি’তে, শি লেখেন ‘সহযোগিতা ও কমন বিকাশের নতুন অধ্যায়’ বিষয়ে, প্রকাশিত হয় ‘রাশান গেজেট’ ও ‘রিয়া নভোস্তি ওয়েবসাইটে।
দুই দিনের আলোচনা ও অজস্র প্রজেক্টের সইসাবুদের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক ঘরোয়া মৈত্রী বা আঁতাত হয়। দুই শক্তিশালী রাষ্ট্র দ্বৈত সত্তায় প্রকাশিত হয় : একজনের রয়েছে বিশালাকার পণ্যোৎপাদনের ভিত্তি, আরেকজনের রয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ কাঁচামালের সরবরাহ, অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং কূটনৈতিক ধী ও সহজবুদ্ধি। উন্মোচনরত বহুমেরু বিশ্বের ক্রান্তিকালে যুক্তরাষ্ট্র আবারও ধারেকাছে কোথাও নেই। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র তার এক মেরুসর্বস্ব হেজিমনির কোনো অংশীদার চায় না।
যুক্তরাষ্ট্রসহ সম্মিলিত পশ্চিম জানে যে ‘স্যাংকশনস ফ্রম হেল’-এর নরকে রেখে প্রক্সি যুদ্ধের সাহায্যে রাশিয়াকে পরাজিত করা অসম্ভব। বরং মার্কিন ব্যাংকগুলো ক্রমশ ভেঙে পড়ছে; ইইউর অর্থনীতি নিশ্চল স্থবিরমুখী।
মিটিং শেষে পুতিনকে শি বলেন যে ‘একশো বছরে ঘটেনি, এমন একটি পরিবর্তন আসছে এবং এই পরিবর্তন আমরা একত্রে চালনা করছি।’ ‘পরিবর্তন’ বলতে শি বাণিজ্য, সামরিক বিনিময়, মুদ্রা সিস্টেম পরিবর্তনের কথা বলেননি; কারণ এগুলো ইত্যবসরেই পরিবর্তনের অন্তর্ভুক্ত অবিচ্ছেদ্য বিষয়ের অন্তর্গত। আসলে, শি ও পুতিনের পরামর্শ হলো যে, পাশ্চাত্যের প্রাচ্যদেশত্ব/প্রাচ্যদেশসমৃদ্ধ যে পুরোনো চশমা জোড়া পড়ে বিশ্বকে দেখতে অভ্যস্ত আমরা, আমাদের সেটি ছুড়ে ফেলে দিতে হবে, এবং বিশ্বকে নিয়ে অন্যরকমভাবে ও নানা রকম উপায়ে ভাবনা করতে হবে।