দুই প্রান্ত মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে এসে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন। সকালে হেলিকপ্টারে করে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে মাওয়া আসবেন প্রধানমন্ত্রী। সকাল সাড়ে ১০টায় মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন তিনি। ১১টায় স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধনী খাম ও সিলমোহর প্রকাশ করবেন। ১১টা ১২ মিনিটে টোল প্রদান করে মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচন করে মোনাজাতে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী। ১১টা ২৩ মিনিটে মাওয়া প্রান্ত থেকে সেতুর ওপর দিয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা আসবেন প্রধানমন্ত্রী। পৌনে ১২টায় এখানে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-২ উন্মোচন করে মোনাজাতে অংশ নেবেন। বেলা ১২টায় শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের বাংলাবাজার ফেরিঘাট এলাকায় আওয়ামী লীগের জনসভায় যোগ দেবেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
গতকাল এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত দেশের সর্ববৃহৎ ‘পদ্মা সেতু’ যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার দিনকে বাংলাদেশের জন্য এক গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক দিন হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, দেশপ্রেমিক জনগণের আস্থা ও সমর্থনের ফলেই আজকে উন্নয়নের এ নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে। আগামী দিনেও গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন পূরণে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করে যাব।
প্রধানমন্ত্রী চ্যালেঞ্জিং ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প’ বাস্তবায়নে নিয়োজিত সর্বস্তরের দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী, পরামর্শক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, নিরাপত্তা তদারকিতে নিয়োজিত সেনাবাহিনী ও নির্মাণ শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে তাদের অবদান ও অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য অভিবাদন জানান।
সেতুর দুই প্রান্তের জনগণ জমি প্রদানের মাধ্যমে এবং নানাভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করায় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং ‘পদ্মা সেতু’ উদ্বোধনের এ মাহেন্দ্রক্ষণে দেশবাসীকে তিনি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ এনে মামলা করে। কানাডা আদালত বিশ্বব্যাংকের উত্থাপিত সব অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বলে রায় দেন। সব দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বব্যাংকের ঋণ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিলে জনগণের কাছ থেকে বিপুল সমর্থন পাই। জনতার শক্তি হৃদয়ে ধারণ করে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে আজ আমরা স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছি। দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। দুর্নীতিমুক্ত বীরের জাতি হিসেবে বাঙালি নিজেদের বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
উদ্বোধনের পরদিন আগামীকাল ২৬ জুন ভোরে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে বহুল প্রত্যাশিত এ সেতু। এতে ১৩ ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে। তবে নসিমন, করিমন, ভটভটি ও সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করতে পারবে না। এমনকি হেঁটেও মানুষ যাতায়াত করতে পারবে না। এরই মধ্যে পদ্মা সেতুতে গাড়ি পারাপারে টোল নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করেছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি)। ঠিকাদার তাঁর কাজ শেষ করে সেতু বুঝিয়ে দিয়েছেন সরকারকে। তবে আগামী এক বছর তাঁরা রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করবেন।
সরকার, জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা থাকবেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে দেশে কর্মরত কূটনীতিকদের, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত বিশিষ্টজনদের। এমনকি যারা পদ্মা সেতুর বিরোধিতা করেছিলেন তাদেরও। সকাল ১০টায় উদ্বোধনের ফলক উন্মোচনের পর সুধী সমাবেশে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর উঠবেন স্বপ্নের সেতুতে। নিজের গাড়ির টোল দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই প্রথম পদ্মা সেতু পেরিয়ে যাবেন ওপারে শরীয়তপুরের জাজিরায়। সেখানে আরেকটি উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী। তারপর কাঁঠালবাড়ী ঘাট এলাকায় দুপুরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দেবেন দলের প্রধান শেখ হাসিনা। উদ্বোধন ঘিরে পদ্মা সেতু ও দুই প্রান্তের আশপাশ এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করে নিতে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। রাস্তার দুই পাশে সাঁটানো হয়েছে বিশাল বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন। নানা রঙে সাজানো হয়েছে রাস্তা। বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী আয়োজনের ব্যস্ততার ফাঁকে হয়ে গেল নিরাপত্তা মহড়া।
টোল দেওয়া যাবে তিন সেকেন্ডে : পদ্মা সেতুতে রয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির টোল আদায়ের বুথ। কাল ভোর ৬টা থেকে সরকার নির্ধারিত টোল দিয়ে সেতুতে যানবাহন চলাচল করতে পারবে। এর মাধ্যমে চলমান গাড়ি থেকে মাত্র তিন সেকেন্ডে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টোল আদায় করা যাবে বলে জানিয়েছেন সেতু কর্তৃপক্ষ।
পদ্মা সেতু উদ্বোধন-পরবর্তী জনসভার সমন্বয়কারী ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম এমপি বলেন, ‘৭ মার্চের জনসভার পর পদ্মা সেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জনসভা হবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসভা। প্রধানমন্ত্রী বাংলাবাজার ঘাটে ঐতিহাসিক জনসভার মধ্য দিয়ে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত হবেন। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা যুক্ত হতে পারব বিশ্ববাসীর সঙ্গে।’ গতকাল সকালে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী সভাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলাসহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে কয়েক লাখ মানুষ এ জনসভায় যোগ দেবে। নৌপথে যারা আসবে তারা যাতে ঘাট এলাকায় এসে নির্বিঘ্নে নামতে পারে সেজন্য ১৫টি পন্টুন স্থাপন করা হয়েছে।’
পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম বলেন, ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু বঙ্গবন্ধুকন্যার কারণেই সম্ভব হয়েছে। গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ বঙ্গবন্ধুর বীর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ও অভিবাদন জানানের জন্য অপেক্ষা করছে। পদ্মার পাড়ে রীতিমতো উৎসব শুরু হয়েছে। এ উৎসবে গোটা দেশের মানুষ অংশ নেবে।’
গতকাল বিকালে সরেজমিন দেখা যায়, অনুষ্ঠানস্থল, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে সাজসজ্জায় ভরে উঠেছে। এক্সপ্রেসওয়েতে সাজানো হয়েছে বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন। পদ্মা সেতু নির্মাণ করায় স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে টানিয়েছেন ফেস্টুন। সমাবেশস্থলের দৃষ্টিনন্দন মঞ্চ তৈরিসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার কাজ শেষ। মাওয়ায় প্রস্তুত রয়েছে উদ্বোধনী ফলক মঞ্চ ও ম্যুরাল। অনুষ্ঠানস্থলের আশপাশের সৌন্দর্যবর্ধনেও শেষ ছোঁয়া চলছিল।
উচ্ছ্বসিত স্থানীয়রা : পদ্মা সেতুর উদ্বোধন কেন্দ্র করে মাওয়ার পদ্মাপারের সাধারণ মানুষ আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। গতকাল মাওয়া বাজারে কথা হয় স্থানীয় মো. রিপনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা হয়তো খুব একটা সেতু পার হব না। তবে এ সেতুর কারণেই নদী ভাঙন থেমেছে। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এত দিনে এ জায়গা হয়তো নদীগর্ভে চলে যেত।’ তিনি বলেন, ‘এ সেতু নিয়ে কত কথা হয়েছে, কত শঙ্কার কথা শুনেছি। তবে কাল (আজ) সেতু উদ্বোধন হচ্ছে। এটা দেখে খুব আনন্দ হচ্ছে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও ধন্যবাদ জানান স্থানীয় এই বাসিন্দা। মাওয়া চৌরাস্তায় মিষ্টি বিক্রেতা জালাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কত কথা হুনছি, সেতু নাকি ভাঙ্গা যাইব। কিন্তু সেই সেতু তো আজকা উদ্বোধন হইতাছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে।’ মাওয়া আড়তের মাছ ব্যবসায়ী কামাল জানান, ‘কখনো ভাবিনি এ নদীতে সেতু হবে। কত কষ্ট করে পার হতো মানুষ। আজকের পর আর থাকবে না কোনো কষ্ট। খুব ভালো লাগছে।’