আমাদের দেশে হিরো আলমকে নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, মুরগি নিয়ে আলোচনা তার চেয়ে কম হয় না। উচ্চমূল্যের কারণে মুরগি এখন দেশব্যাপী আলোচিত। যদিও আলোচনা, সমালোচনা, ক্ষোভ, বিদ্রূপ, ঠাট্টা-তামাশায় কোনো কিছুর দাম কমে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসের মতো মুরগি ও মুরগির ডিমের দামও এখন মাত্রাছাড়া। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। রড-সিমেন্টের মূল্যবৃদ্ধির জন্য যেমন রিজার্ভ-সংকট, ডলারের দাম, ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানিসংকটকে দায়ী করা হয়, ডিম আর মাংসের মূল্যবৃদ্ধির জন্য এগুলো দায়ী নয়। এর জন্য দায়ী মূলত করপোরেট কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেট। মুরগি ও ডিম উৎপাদনের ক্ষেত্রে এখন করপোরেট কোম্পানিগুলোর শেয়ার রয়েছে ১০ শতাংশ। তবে বাচ্চা, ফিড ও অন্যান্য উপকরণ তাদের শতভাগ দখলে। এসব উপকরণ ব্যবহার করে যখন তারা মাংস ও ডিম উৎপাদনে যাচ্ছেন, তখন সাধারণ খামারিরা টিকতে পারছেন না। এর মধ্যে আবার করপোরেট কোম্পানিগুলো বন্ধ হওয়া খামারে কম মূল্যে ফিড ও বাচ্চা দিয়ে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করছে। সেজন্য নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে তাদের হাতে। তারা ইচ্ছেমতো ডিম ও মাংসের দাম বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছেন। এই সিন্ডিকেটওয়ালাদের বিরুদ্ধে সরকার মাঝে মাঝে হুংকার ছাড়ে। হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। কিন্তু তারা এসব হুংকার-হুঁশিয়ারিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঠিকই দাম বাড়িয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। যাদের আয়-উপার্জন ভালো, দাম বাড়লে তাদের তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু নির্দিষ্ট আয়ের সাধারণ নাগরিক ও গরিব মানুষরা ক্রমেই ডিম-ও মুরগির মাংস থেকে বঞ্চিত হন। এতে তাদের পুষ্টিরও অভাব দেখা যায়। কিন্তু গরিবের পুষ্টি নিয়ে আর কে মাথা ঘামায়?
ডিম ও মোরগ-মুরগির দাম নিয়ে আমাদের অবশ্যই মাথা ঘামানো উচিত। কারণ মানবসভ্যতা বিকাশে মোরগ-মুরগির অবদান অপরিসীম। মোবাইল ইন্টারনেটের মতো মুরগির ডিম, মুরগির মাংস না হলে আধুনিক মানুষের জীবন চলে না।
উল্লেখ্য, মুরগি আমাদের দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রাণী। একে কুক্কুট বা কুঁকড়া নামেও ডাকা হয়। মুরগি শব্দটি এসেছে ফারসি থেকে। ফারসি শব্দ ‘মুর্গ’ মানে মোরগ। বাংলায় মুরগি মোরগের স্ত্রীলিঙ্গ। অনেকে মোরগকে ‘মুর্গা’ বলেও ডাকেন। মুরগির ইংরেজি প্রতিশব্দ চিকেন এখন ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
ডিম-মাংস দুই-ই দেয় বলে আমাদের দেশে মুরগির খ্যাতি বেশি। তুলনামূলকভাবে মোরগের খ্যাতি কম। সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘একটি মোরগের আত্মকাহিনী’ লিখে সাড়া ফেলেছিলেন। বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি মোরগ নামের অবহেলিত প্রাণীটিকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। তবে অনেক দেশে মুরগির চেয়ে মোরগ খ্যাতিমান। তুরস্ক, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় মোরগ লড়াই প্রায় জাতীয় পর্যায়ের খেলার অন্তর্ভুক্ত! বাংলাদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল এলাকায় এখনো মোরগ লড়াই একটি প্রসিদ্ধ খেলা হিসেবে টিকে আছে।
মোরগ লড়াইয়ের খেলাটা বেশ প্রতীকী। আমাদের দেশের রাজনীতির সঙ্গে মিল আছে। একটি মোরগকে অন্য মোরগের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলে লড়াই বাধানো হয়। দুই মোরগের মরণপণ লড়াইয়ের হার-জিতে মোরগের পাওনা থাকে শূন্য! জিত হয় মোরগ মালিকের, অর্জন করে নগদ পুরস্কার!
প্রয়োজনীয় আমিষের জোগান দিয়ে মানবজাতিকে কর্মক্ষম রেখেছে এই মোরগ-মুরগি! মানবসভ্যতা রক্ষায় ও মানবজাতিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় নেতা-নেত্রীদের চেয়ে মোরগ-মুরগির আত্মত্যাগ ও অবদান কোনো অংশে কম নয়। মুরগির ডিম না থাকলে দুনিয়ার বেকারিগুলো অচল হয়ে পড়ত। বিস্কুট, কেক, রুটি, পাউরুটি, বান, মিষ্টিসহ শত শত ধরনের খাদ্যসামগ্রী তৈরি করা সম্ভব হতো না। সহজে বহনযোগ্য, লম্বা স্থায়িত্ব, সব জলবায়ু উপযোগী, সুস্বাদু আমিষ হিসেবে মুরগির ডিমের কোনো বিকল্প নেই। অপটু অকর্মণ্য ব্যক্তিও মুরগির ডিম দিয়ে খাদ্য তৈরি করতে পারে। ডিমের পুষ্টিগুণের কোনো তুলনা নেই। ভিটামিন ‘সি’ ছাড়া বাকি সব ভিটামিন পাওয়া যায় না। ডিমের ভেতর সব আছে, ভিটামিন-সি নেই কেন? এর কারণ হিসেবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেন, আমরা যেমন ভাতের সঙ্গে লেবু খাই, মুরগির সে রকম অভ্যাস নেই। তাই ডিমে ভিটামিন-সি নেই।
মুরগির মাংস যদি না থাকত কেন্টাকি, বার্গার, ম্যাকডোনাল্ডসসহ হাজারো কোম্পানির জন্ম হতো না। ফাস্টফুড বলতে কোনো কথা ডিকশনারিতে থাকত না। স্যান্ডউইচ, হটডগ, নাগেটস, মিট বলসহ মুরগির মাংসনির্ভর আরো অসংখ্য কোম্পানির সৃষ্টি হতো না। মুরগির মাংসের তুলনামূলক কম দাম। গরিব-মেহনতি মানুষ গরু-ছাগলের মাংস খেতে না পারলেও একটু চেষ্টায় কম খরচে মুরগির মাংস জোগাড় করতে পারে। মুরগির মাংস পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ামুক্ত, সহজে হজমযোগ্য; রোগী, শিশু থেকে শুরু করে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকেও এর মাংস খাওয়ানো যায়।
বর্তমানে ব্রয়লার বা ফার্মের মুরগি আসার আগে বাঙালি সমাজে মুরগি একটি অভিজাত খাবার ছিল। তখন মানুষ মাঝেমধ্যে মুরগি খেত। যদিও সে সময় অধিকাংশ বাড়িতেই মুরগি পালন করা হতো। তখন মুরগি নিয়ে প্রচলিত একটি কথা ছিল, গরিব মানুষ মুরগি খায় দুই অসুখে। এক, যখন গরিব মানুষ নিজে অসুখে পড়ত আর দুই, যখন মুরগি নিজে অসুখে পড়ত!
মুরগি নিয়ে অনেক কৌতুক আছে। একবার এক লোক বাজার থেকে মুরগি নিয়ে ফিরছিল। পথে এক মাতাল বলল, ‘এই খাসিটাকে নিয়ে কোথায় চললে?’ মাতালের প্রশ্ন শুনে লোকটি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘মাতাল কোথাকার! এইটা মুরগি, খাসি না।’ মাতাল জবাব দিল, ‘আমি মুরগিটাকেই জিগ্যেস করছিলাম!’
বিদেশেও মুরগি নিয়ে অনেক গল্প চালু আছে। তেমন একটা গল্প উল্লেখ করা যাক। গির্জায় কনফেশন চলছে। অনেকেই নীরবে ফাদারের কাছে কনফেশন দিচ্ছেন। এ সময় একজন ব্যাগে করে একটি মুরগি নিয়ে ঢুকল। বলল, ‘ফাদার, আমি এই মুরগিটা চুরি করেছিলাম। সেটা নিয়ে আপনি আমাকে পাপমুক্ত করবেন?’ ফাদার মুরগি না দেখেই বললেন, ‘না, এভাবে হয় না, তুমি যার মুরগি তাকে ফেরত দিয়ে আসো।’ লোকটি বলল, ‘ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু যা দেখছি, মুরগির মালিক তো ফেরত নিতে চায় না।’ ফাদার বললেন, ‘সেক্ষেত্রে তুমি পাপমুক্ত। কারণ তুমি মুরগির মালিককে ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করেছিলে।’ শুনে মুরগি চোর খুশি মনে মুরগি নিয়ে বাড়ি চলে গেল। ওদিকে ফাদার বাড়ি ফিরে দেখেন তার মুরগিটি নেই!
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও মুরগি নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। নিজের দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া গাড়ির পাশে বসে বিলাপ করে কাঁদছিলেন এক সর্দারজি, ‘আমার মুরগিটা মারা গেল। আমার কী হবে?’ এক পথচারী দেখে থমকে গেলেন। বললেন, ‘সে কী সর্দারজি! আপনার এত দামি গাড়ির এই হাল হলো কী করে?’ ‘আর বলবেন না, গাড়িটা রাস্তার পাশে রেখে আমি গিয়েছিলাম একটু দোকানে। কথা নেই বার্তা নেই, এক ট্রাক ড্রাইভার তার বেঢপ ট্রাকটা আমার গাড়ির ওপর উঠিয়ে দিল। আর গাড়ির পেছনে থাকা আমার মুরগিটা গেল মরে।’ বলে আবার বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন সর্দারজি। পথচারী ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘এত দামি গাড়িটা একেবারে ভেঙেচুরে গেল, আর আপনি কিনা মুরগির জন্য কাঁদছেন?’ সর্দারজি বললেন, ‘আরে বোকা, গাড়ি দিয়ে কী হবে? গাড়ি তো আর প্রতিদিন একটা করে ডিম দেয় না!’
আমাদের বাঙালিদের দেশপ্রেম নাকি মুরগি আর তার ডিম পর্যন্তই। সবাই এক্ষেত্রে দেশিটা চান। মুরগি নিয়ে আমাদের দেশে করপোরেট গল্পও আছে। সায়েন্টিফিক ম্যানেজমেন্টে বস প্রডাক্টশন ছাড়া কিছু বোঝেন না। কোনো এক করপোরেট বসের চাকরি গেলে তিনি মুরগির খামার দেন। কারণ তিনি জানতেন, কর্মী হিসেবে মানুষের চেয়ে মুরগির প্রডাক্টশন রেট ভালো। কিন্তু খামারে লস হচ্ছিল। মুরগিগুলো খুব বেশি ডিম পাড়ত না। একদিন সে রেগে খামারে ঢুকে বলল, ‘আগামীকাল কারো সামনে দুইটা ডিম না পেলে তাকে জবাই করা হবে।’ পরদিন সকালে বস খামারে গিয়ে দেখলেন, সব মুরগির সামনে দুটো ডিম, কিন্তু একটার সামনে মাত্র একটা। বস কারণ জিগ্যেস করলে সে উত্তর দিল, ‘বস, আমি মোরগ।’
মুরগি নিয়ে এমন অসংখ্য গল্প-কৌতুক চালু আছে। সিঙ্গাপুরে একটি কার্টুনে দেখানো হয়েছিল, একটি মুরগি তার বাচ্চাদের নিয়ে কেএফসির প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল স্যান্ডার্সের ছবির সামনে গিয়ে বলছে, এই ব্যক্তিই তোদের বাবার খুনি। যা-ই হোক, মুরগির করপোরেটাইজেশন হওয়ার পরই মুরগির বাচ্চারা বেশি সংখ্যায় এতিম হতে শুরু করেছে! অন্যদিকে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও মুষ্টিমেয় কিছু অর্থলোভী ব্যক্তির কারণে আমরা ডিম আর মাংস থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
স্বাধীনতা বলতে ‘মাংস খাওয়ার অধিকার’ বোঝায় কি না, সে বিতর্কে না গিয়ে সহজভাবে বলা যায়, স্বাধীন দেশে মাংস-ডিম অন্তত যৌক্তিক দামে পাওয়া উচিত। লাভের গুড় যদি করপোরেট কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেটই খেয়ে নেয়, তাহলে আর এত পথ হেঁটে, এত জল ঘেটে আমরা কী পেলাম?