তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। যাতায়াতের পথে প্রায়ই দেখা হতো এক বৃদ্ধের সঙ্গে। প্রথমে কুশলাদি বিনিময়ে সীমাবদ্ধ ছিল সম্পর্কটা। ধীরে ধীরে আলাপ বাড়তে থাকে। কথা বলে তাকে বেশ সচেতন বলে মনে হতো। বৈশ্বিক নানা বিষয়ে খোঁজখবর রাখতেন। দেখা হলে সমসাময়িক নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হতো। রাজনীতি, অর্থনীতি ছাপিয়ে সেখানে উঠে আসত ভৌগোলিক ইতিহাসও। সব সময় হাসিমুখে কথা বলতেন তিনি। একদিন বিকালে তার সঙ্গে দেখা হলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে থাকেন। মুখে সেই হাসি নেই। খটকা লাগে। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, মন খারাপের কারণ। কোনোভাবেই বৃদ্ধ বলতে চাননি। প্রসঙ্গ বদলে জানতে চাইলাম—‘দুপুরের খাবার খেয়েছেন কি না?’ বৃদ্ধ বললেন, ‘না।’ বললাম, ‘চলেন, আমি আপনাকে খাওয়াব আজ।’ বৃদ্ধ বললেন, ‘আমার বাসায় তো রান্না হয়েছে। রুই মাছের মাথা দিয়ে ঘন করে মুগের ডাল, কলমি শাক আর আলু দিয়ে কাঁচা টম্যাটোর চচ্চরি। সবই আমার প্রিয়।
‘তাহলে খাননি কেন?
‘প্রতিবাদস্বরূপ।
‘মানে?
এই বার বললেন বৃদ্ধ লোকটি—‘এক প্রভাবশালী লোক অন্যায়ভাবে আমাকে একটা থাপ্পড় দিয়েছেন। তার প্রতিবাদে আমি আজ দুপুরে খাইনি। বিস্মিত হলাম। ‘আপনাকে অন্যায়ভাবে থাপ্পড় দিয়েছে, তাহলে থানায় চলেন। তার বিরুদ্ধে মামলা করে দিন।
‘মামলা করলে কী হবে? কিচ্ছুই হবে না। তারা প্রভাবশালী। প্রভাবশালী লোকটিকে আমিও চিনতাম। ফলে পরিস্থিতি বোঝাতে আর কিছু বলতে হয়নি। খানিক থেমে বললাম—‘আপনি না খেয়ে থাকলে লাভ কী? ঐ লোকের তো কিচ্ছু হবে না। শুধু শুধু আপনি কষ্ট পাবেন।’ বৃদ্ধের জবাব—‘ঐ লোকের কিছু হবে না, ঠিক। তিনি হয়তো জানবেনও না। তিনি কেন, কেউ-ই জানবে না। কিন্তু আমি তো জানব—আমি প্রতিবাদ করেছি। আমি চুপ করে অন্যায় সহ্য করিনি। আমি প্রতিবাদ করতে জানি। আর আজ যদি কাজ হবে না কারণে চুপ থাকি, তাহলে ধীরে ধীরে আমিও প্রতিবাদ করতে ভুলে যাব। মানুষ এভাবেই প্রতিবাদ করতে ভুলে যায়।’ কিছুটা দম নিয়ে বৃদ্ধ বলেন—‘বেঁচে থাকতে প্রতিবাদ খুবই জরুরি। আজ আমাকে মারছে, আপনি ভাবলেন বেঁচে গেলেন! কিন্তু কাল আপনাকে মারবে, আমি ভাবব—আমাকে মারার সময় তো সে আগায়নি, আমি কেন আগাব? আমরা অন্যের ভেবে চুপ থাকছি। প্রতিবাদ করছি না অথবা প্রতিবাদ করতে ভুলে যাচ্ছি। বুঝতেই পারছি না, কোন ঘটনায় কীভাবে প্রতিবাদ করতে হবে। এভাবেই অন্যায় গেড়ে বসছে। এর দায় আপনার-আমারও কম নয়।
কথাগুলো এত বছর পরও নতুনই রয়েছে। প্রতিনিয়ত এর বাস্তবতা চারপাশে দেখছি। প্রকাশ্য দিবালোকে একজন আরেক জনকে জিম্মি করছে। প্রয়োজন বুঝে পকেট কাটছে। কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না। ফলে ৫২ দিনে পোলট্রি মাফিয়া চক্র হাতিয়ে নিতে পারে ৯৩৬ কোটি টাকা। তেল ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট গড়ে সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিগুণ মূল্যবৃদ্ধি করতে পারে অনায়াসে। বাসবোঝাই যাত্রীর সামনেই আরেক যাত্রীকে জিম্মি করে বেশি ভাড়া হাতিয়ে নিচ্ছে বাসশ্রমিক। কারো কোনো প্রতিকার নেই। এসবই হচ্ছে আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবের জন্য। স্বাভাবিক সময়ে চাল, চিনি, মাছ, মাংস, ভোজ্য তেল আর সবজি এবং রমজানে ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচের মতো ভোগ্যপণ্যের কারণে যাদের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত তারা হিমশিম খায়। কিন্তু এ দেশে এমন একটি অস্বাভাবিক অর্থ উপার্জনকারী চক্র আছে যারা অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও এসব তোয়াক্কা না করে যত দাম হোক, সেসব কেনে। এ কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কখনো ভাটা পড়ে না। বৈষম্যমূলক আয় এবং অর্থনৈতিক অবস্থানগত কারণে ক্রয়ক্ষমতায় অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি করে আর দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটতেই থাকে। এখানেই সুশাসনের প্রশ্ন। মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারি—বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরীক্ষায় নিম্ন মান প্রমাণিত হওয়ায় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য জব্দ, ধ্বংস ও পণ্য উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দেয় আদালত। এই তালিকায় দেশের নামকরা ব্র্যান্ডগুলোর পণ্যই বেশি দেখা যায়। পণ্যগুলোর গায়ে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন স্টিকারও থাকে। সেগুলো দেখে বছরের পর বছর বিশ্বাস করে কেনেন সাধারণ ভোক্তারা। এই ভোক্তা তালিকায় কে নেই? সরকারি আমলা থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ হওয়া কোম্পানির কমকর্তা-কর্মচারী পর্যন্ত সবাই তো দিন শেষে ভোক্তা। যে বিএসটিআই কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে পরীক্ষা করে মান নির্ধারণ করার দায়িত্ব অবহেলা করে বছরের পর বছর এসব মানহীন পণ্য বিক্রিতে সহায়তা করলেন, তারা কি এসব খাবার থেকে মুক্ত ছিলেন? অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের একটি কথা ঘুরে ফিরে মনে হতে থাকে—‘পৃথিবীতে ভালো মানুষের সংখ্যাও কম নয়, তবে তারা বিচ্ছিন্ন।’ এই বিচ্ছিন্নতাবোধ যতদিন দূর না হবে, আমরা যতদিন না একত্রিত হতে পারব, ততদিন কোনো সিন্ডিকেট ভাঙাই সম্ভব নয়। মাঝেমধ্যে কিছু প্রতিবাদ, ঐক্য আমাদের আশা জাগায়। ফলও আসে। উদাহরণ হিসেবে গণজাগরণ মঞ্চের কথা উল্লেখ করা যায়। এছাড়াও সোনাগাজীর নুসরাত হত্যার রায়, ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরা, হাফ পাশ চালু করা, মাঝেমধ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানসহ কিছু ঘটনা পাওয়া যায়। অপ্রতুল হলেও এসব আশা জাগায়। একটি গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের ঐক্য ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব নয়। সরকারের ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময় গণজোয়ারের অপেক্ষা থাকে। সেটি তৈরি করতে ঐক্যের বিকল্প নেই। প্রতিবাদ বাঁচিয়ে রাখার বিকল্প নেই।