হামিদুল ইসলাম (৩৫) ব্রহ্মপুত্র নদবেষ্টিত উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চল মশালের চরের আব্দুল মজিদের পুত্র। বাবা-মা স্ত্রী-সন্তানসহ সাত সদস্যের সংসার তার। পুরনো কাগজের ব্যবসা করে পরিবারের ভরণ-পোষণ জোগাতেন তিনি। কয়েক দিন আগে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের কবলে পড়ে সুদের টাকায় কেনা ব্যবসার একমাত্র বাহন নৌকাটি নদীতে ডুবে যায়।আয়-রোজগার বন্ধ হয় হামিদুলের। পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম বিপাকে পড়েন তিনি। এর পরই শুরু হয় বন্যা। এ যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা।
হামিদুল ইসলাম বলেন, ‘সুদে ৪০ হাজার টাকা নিয়েছি। কিন্তু বন্যা এসে সব শেষ করে দিল। আমি গরিব মানুষ। আবাদ কিস্তি কিছুই নেই। একসঙ্গে অনেকগুলো লোকের খাবার জোগাতে হয়। ‘ প্রায় দুই সপ্তাহের বন্যায় খেয়ে না খেয়ে ছিলেন তারা। কোনো বেলা খেলেও তা পেট ভরে খাওয়া হয়নি তাদের। প্রায় ১৫ দিন পানিবন্দি হয়ে থাকলেও ত্রাণ হিসেবে দুই কেজি চাল ও এক কেজি আলু পেয়েছে পরিবারটি।
কুড়িগ্রামে ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কমে ধীরে ধীরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। পানি কমার সাথে সাথে দুর্ভোগ বেড়েই চলছে বন্যাকবলিতদের। প্রায় দুই সপ্তাহের বন্যায় ঘর-বাড়ি আসবাবপত্র নষ্ট হওয়ার উপক্রম। ক্ষতি হয়েছে ফসলি জমির। বন্যাকবলিত এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ হয়েছে। রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হওয়ায় গ্রামীণ জনজীবনে যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
পূর্ব মশালের চরের রোকেয়া বেগমের (৫৫) বসতবাড়ি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। স্বামী শামসুল ফকির ও আট বছরের নাতি নূরে এলাহীকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন একটি আধাভাঙা নৌকায়। প্রায় ১৫ দিন নৌকায় মানবেতর জীবন যাপন করছে পরিবারটি। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কমতে শুরু করলেও দুর্ভোগ কমেনি তার। বাড়ি থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও, এখনো ঘরে ফেরা হয়নি তাদের।
এ সময় তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘বানের পানিত আবাদ কিস্তি ডুইবা গেছে, খামু কী? অভাবের সংসার, পোলার বাপে কামকাজ কইরবার পারে না। আইজ পনেরো দিন থাইকা পানিতে ভাসতাছি। বাড়ি থাইকা পানি নামছে। কিন্তু হেই বাড়ি ঠিকঠাক করতে অনেক সময় লাগবে। ‘ তিনি আরো বলেন, ‘আমগো কষ্ট দেইখানোর মানুষ নাই। ত্রাণ চাই না, সরকার আমগো বাড়ি উঁইচা করে দেউক। ‘
দুর্গম মুছার চরের হতদরিদ্র জামাল মিয়া। বন্যার হাত থেকে মুক্তি পেতে বসতভিটার এক কোণে মাচা তৈরি করেছেন তিনি। সেখানেই স্ত্রী বুলবুলি বেগম, মেয়ে জাহানারা বেগম ও তিন বছরের নাতি জুনাইদসহ গবাদি পশুর সাথেই রাত কাটাচ্ছেন তারা।
জামাল মিয়ার ভাষ্যমতে, সাত বছর ধরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ওই চরে বাস করেন তিনি। অভাবের সংসার। দিনমজুরি করে যা আয় হয় তা দিয়েই টেনেটুনে সংসার চালান তিনি। বাড়ি উঁচু করার সাধ্য নেই। প্রতিবছর বন্যায় অবর্ণনীয় কষ্টে জীবন যাপন করেন তিনি।
বন্যা আসে, আবার চলেও যায়। কিন্তু দুঃখের সীমা থাকে না চরাঞ্চলের মানুষের। নামকাওয়াস্তে ত্রাণ দিলেও তা সুষম বণ্টন হয় না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের স্বজনপ্রীতির কারণে বঞ্চিত হয় প্রকৃত বন্যাদুর্গতরা। প্রতিবছর বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর অবিরাম সংগ্রাম যেন শেষ হয় না। নদী খননসহ ঘরবাড়ি উঁচু করার দাবি ভুক্তভোগীদের। ত্রাণ নয়, পরিত্রাণ চায় বানভাসিরা।