এ বছর (২০২৩) ১৯ ফেব্রুয়ারি গুলশানের একটি ১২তলা ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় দুই জন নিহত হয়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি আগুন লেগেছিল কড়াইল বস্তিতে। ২৭ মার্চ রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে ও একই দিনে আগুন লাগে কাপ্তান বাজার জয়কালী মন্দিরসংলগ্ন সুইপার কলোনিতে। বছরের সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পঞ্চম ঘটনাটি বঙ্গবাজার।
৪ এপ্রিল মঙ্গলবার ভোর ৬টা ১০ মিনিটের দিকে ঢাকার বঙ্গবাজার মার্কেটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। খবর পাওয়ার দুই মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট। বেলা ১১টা নাগাদ ৫০টি ইউনিট ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। এর পরও আগুন বেপরোয়া, ৫০টি ইউনিটের সঙ্গে যোগ দেয় বাংলাদেশ সেনা ও বিমান বাহিনীর সাহায্যকারী ও নৌবাহিনীর সম্মিলিত দল, আগুন নেভানো ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে পুলিশ বাহিনীর ২ হাজার সদস্য দায়িত্ব পালন করেছেন। আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়েছে সেনা ও বাহিনীর হেলিকপ্টার ইউনিট ও জলকামান। টানা ছয় ঘণ্টা অক্লান্ত চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। আধুনিক যুগে আগুন নেভানো বা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা বা অসক্ষমতার হিসাব মিলানোর আগে বহু আপদ-বিপদের দেশে ফি বছর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্র কোথায়? তার হিসাব মেলানো এখন সময়ের দাবি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ, বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডে দোকান পুড়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১ হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক বলেছেন, ‘মার্কেট ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, ১০ বার নোটিশ দেওয়া হয়েছে’। যদি এই কথাই সত্য হয়, তবে তা ব্যবসায়ীদের এবং সেখান থেকে অর্থ গ্রহণকারীদের অবহেলার কারণ কী? তা খতিয়ে দেখা উচিত।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ১ লাখ ১০ হাজার ৪৯২টি। এসব ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। গত বছর (২০২২) আগুন লাগার ঘটনায় ক্ষতি হয়েছে ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। বিগত ১০ বছরে ক্ষতির পরিমাণ সোয়া ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজার এলাকায় আগুন লেগে ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত দুই শতাধিক। ২০১২ থেকে ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছে ১ হাজার ১৭৬ জন। এর মধ্যে ২০১২ সালে ২১০ জন, ২০১৩ সালে ১৬১ জন, ২০১৪ সালে ৭০ জন, ২০১৫ সালে ৬৮ জন, ২০১৬ সালে ৫২ জন, ২০১৭ সালে ৪৫ জন, ২০১৮ সালে ১৩০ জন, ২০১৯ সালে ১২০ জন, ২০২০ সালে ১৫৩ জন, ২০২১ সালে ৬০ জন, ২০২২ সালে ১০৬ জন। এ সময়ের আহতের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। আগুন লাগার গতানুগতিক তথ্যাদি, শহরের ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, লিকেজ গ্যাসলাইন কিংবা দাহ্য পদার্থ। গ্রামের ক্ষেত্রে যে তথ্যাদি অসাবধানতার জন্য চুলা বা খড়ের আগুন। এবিষয়ে ফায়ার সার্ভিস সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের ভাষ্যও খুবই সহজ-সরল, ‘অসাবধানতা অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণ, এক্ষেত্রে জনসচেনতা বাড়ানোর জন্য ট্রেনিং দরকার। আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা পর্যাপ্ত।’ তাদের এই ভাষ্য যদি সত্য হয়, তবে ট্রেনিংয়ের জন্য বরাদ্দ জরুরি, এরপর যা হবার তাই।
বাংলাদেশে যত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তাতে গতানুগতিক তথ্যাদির বাইরে কোনো অনুসন্ধানী তথ্যাদি সরকার সংশ্লিষ্ট কিংবা সাংবাদিক বন্ধুরা খুঁজে বের করতে পারেননি। উদ্ঘাটন হয়নি কারণ বা রহস্য। মামলা-মোকদ্দমার তো প্রশ্নই আসে না। কখনো তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তার প্রতিবেদন অপ্রকাশিত থাকে। দুর্ঘটনাজনিত আগুন লাগা, নৌকাডুবি, সড়কে রক্ত ঝরতেই পারে। প্রাকৃতিক কারণে ভূমিকম্প, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা-খরা হতেই পারে। তাই বলে প্রতি বছর প্রতিক্ষণ! আমরা আবেগপ্রবণ জাতি; আমাদের আদর্শ, স্বভাব-চরিত্র, ক্ষোভ, হিংসা-প্রতিহিংসা, প্রতিশোধের নেশা যেমন বিবেকে ঘিরে থাকে, তেমনি রিপুর তাড়না, লোভ-লালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তিমহল, গোষ্ঠী দ্বারা নাশকতা ঘটছে কি না, তা ক্ষতিয়ে দেখার দায়িত্বও সরকার সংশ্লিষ্টদেরই নিতে হবে। দেশের বিভিন্ন কারখানা, স্থাপনা বা হাটবাজারে যেসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে, তার অন্তরালে অনেক জানা-অজানা ঘটনা, অঘটনা, রহস্য-অরহস্য থাকতেই পারে। জাতীয় এক দৈনিক পত্রিকার অনলাইন ভার্সন রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘আগুন থেকে রক্ষা করা মালামাল চুরি হওয়ার অভিযোগ করেছেন একজন ব্যবসায়ী।’ আর ভোঁতা তদন্ত কমিটি নয়, সম্পদ ও জীবন রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজন শক্তিশালী রহস্য উদ্ঘাটন কমিটি জরুরি হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েকটি অনলাইন পোর্টালে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, ‘সার্বিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত একনেকের সভায় বলেছেন, ‘বারবার অগ্নিকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে এবং এর স্থায়ী সমাধানে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বা ঘোষণা দ্রুত কার্যকর হোক এমনটিই কামনা করছি।