ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড (আইএমএফ) বাংলাদেশের অনুকূলে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। মোট সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এই ঋণ বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড়করণ করা হবে। ইতিমধ্যেই সংস্থাটি অনুমোদিত ঋণের প্রথম বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড়করণ করেছে। আইএমএফের প্রতিটি ঋণই শর্তযুক্ত। তাই বাংলাদেশকে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণপ্রাপ্তির জন্য বেশ কিছু শর্ত মেনে নিতে হয়েছে। বাংলাদেশ এসব শর্ত পরিপালনের জন্য অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের অনুকূলে অনুমোদিত ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড়করণের জন্য কোনো শর্ত পালন করতে হয়নি। তবে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার আগে সংস্থাটি দেখতে চাইবে, তাদের দেওয়া শর্তগুলো পরিপালনে বাংলাদেশ কতটা আন্তরিক। কোনো কারণে বাংলাদেশ যদি আইএমএফের দেওয়া শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে অনুমোদিত ঋণের পরবর্তী কিস্তিসমূহ স্থগিত, এমনকি বাতিলও করা হতে পারে। তাই বাংলাদেশ আইএমএফের দেওয়া শর্তগুলো পরিপালনের জন্য সচেষ্ট রয়েছে। আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণদানের বিপরীতে যেসব শর্ত পরিপালনের অঙ্গীকার আদায় করেছে, তার মধ্যে আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার অন্যতম। বিশেষ করে, তারা বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা রোধের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ পরিসংখ্যানে ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা প্রদর্শন করলেও আইএমএফ এটা মানতে নারাজ। তারা মনে করছে, ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক মামলাধীন প্রকল্পের কাছে পাওনা ঋণাঙ্ক মোট খেলাপি ঋণের হিসাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে না। আইএমএফ এক বছরের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার অর্ধেকে নামিয়ে আনার জন্য পরামর্শ দিয়েছে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রচলিত ব্যাংক কোম্পানি আইন সংস্কারের জন্য আগামী জুন মাসের মধ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলেছে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের এক সভায় ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩-এর খসড়া অনুমোদিত হয়েছে। জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে এই খসড়া আইনটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপিত হতে পারে। ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩ কতটা চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে শুরু করেছে। সংশোধিত খসড়া ব্যাংক আইনের একটি উল্লেখযোগ্য ধারা হচ্ছে, এতে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকে একই পরিবার থেকে একযোগে চার জন পরিচালকের পরিবর্তে তিন জন পরিচালক থাকার বিধান রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগে অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের আপত্তি উপেক্ষা করে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকে একই পরিবার থেকে একযোগে চার জন পরিচালক নিয়োগের বিধান প্রণয়ন করা হয়। তারা অব্যাহতভাবে তিন টার্ম (প্রতি টার্ম তিন বছর) দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এর আগে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকে একই পরিবার থেকে একযোগে দুই জন পরিচালক নিয়োগের বিধান ছিল। তারা দুই টার্ম দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। প্রস্তাবিত খসড়া আইনে একই পরিবার থেকে চার জনের পরিবর্তে তিন জন পরিচালক নিয়োগের বিধান করা হলেও তাদের মেয়াদকাল কতদিন হবে, তা নিয়ে কিছু বলা হয়নি। অর্থাৎ তারা তিন টার্ম দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এরপর এক টার্ম গ্যাপ দিয়ে আবারও তিন টার্ম দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। একই পরিবার থেকে একযোগে দুই জনের বেশি পরিচালক নিয়োগের বিধান বাতিল করা যেতে পারে। এছাড়া তাদের অব্যাহত মেয়াদকাল তিন টার্মের পরিবর্তে দুই টার্ম করা যেতে পারে।
প্রস্তাবিত খসড়া আইনে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে ধারাটি সংযোজন করা হয়েছে তা হলো, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিতকরণের উদ্যোগ। অনেক দিন ধরেই দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টগণ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি জানিয়ে আসছিলেন। প্রস্তাবিত খসড়া আইনে অন্তত সে ধরনের একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, দেশে দুই ধরনের ঋণখেলাপি প্রত্যক্ষ করা যায়। এদের মধ্যে একটি শ্রেণি হচ্ছে, যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নানা কারণে সামর্থ্যহীন হয়ে পড়ায় ঋণের কিস্তি সঠিক সময়ে নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছেন না। এরা প্রকৃত ঋণখেলাপি। এদের নানাভাবে প্রণোদনা দিয়ে ঋণ পরিশোধে সামর্থ্যবান করে তোলা যেতে পারে। ঠিক যেমন চৈত্র মাসে টিউবওয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেলে পাইপে পানি ঢেলে পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হয়। পানি উত্তোলনের জন্য টিউবওয়েলের পাইপে পানি ঢালা কোনো অপচয় নয়। বরং এটি হচ্ছে একটি বিনিয়োগ মাত্র। আর একশ্রেণির ঋণখেলাপি আছেন যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছে করে বা পরিকল্পিতভাবে ঋণের কিস্তি প্রদান থেকে বিরত থাকেন। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা অত্যন্ত পাওয়ারফুল এবং এরা সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের নিকটবর্তী থাকতে পছন্দ করেন। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা দেশ ও জাতির শত্রু। তারা যে কাজ করছে তা ‘ক্রিমিন্যাল অফেন্স’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। তাই তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া উচিত নয়। প্রস্তাবিত ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩ এই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণ বা তার ওপর আরোপিত সুদ যদি পরিশোধ না করেন, তাহলে তিনি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবেন। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে জালিয়াতি বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিজের বা পরিবারের সদস্যদের নামে ঋণ বা আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করলে সেটাই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞায় পড়বে। একই ভাবে যে উদ্দেশ্যে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে, সেই উদ্দেশ্যে ঋণের অর্থ ব্যবহার না করে অন্য কোনো খাতে প্রবাহিত করলে বা বিদেশে পাচার করলেও সেটাও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি বলে বিবেচিত হবে। ব্যাংক কোম্পানির পরিচালক বা তাদের পরিবারের কোনো সদস্য ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে চাইলে তাকে উপযুক্ত জামানত প্রদান করতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা যেতে পারে। এছাড়া তারা যাতে বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি না পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। নির্মোহভাবে এই কাজগুলো করা গেলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপ-প্রবণতা অনেকটাই হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক নিকট অতীতে ব্যাংকিং সেক্টরে কিছু আইনি পরিবর্তন করা হয়েছে, যেগুলো ঋণখেলাপি প্রবণতাকে উত্সাহিত করছে। এসব আইনি সংস্কার বাতিল করে ব্যাংক কোম্পানি আইনকে তার পূর্বরূপে ফিরিয়ে আনতে হবে। যেমন—ঋণ হিসাব অবলোপন প্রক্রিয়া সহজীকরণ করা হয়েছে, যা মোটেও ঠিক হয়নি। আগে কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণীকৃত হওয়ার পর পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের এবং শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণপূর্বক সেই ঋণ হিসাব অবলোপন করা যেত। এখন কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণীকৃত হওয়ার পর তিন বছর অতিক্রান্ত হলেই তা অবলোপন করা যাচ্ছে। শত ভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান তুলে দেওয়া হয়েছে। ৫ লাখ টাকার নিচের কোনো ঋণ হিসাব অবলোপন করতে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করতে হয় না। আগে কোনো ঋণ হিসাব পুনঃ তপশিলিকরণ করতে হলে মোট খেলাপি ঋণের ১০ শতাংশ এককালীন ডাউন পেমেন্ট হিসেবে ব্যাংকে জমা দিতে হতো। কিছু দিন আগে ঋণ হিসাব পুনঃ তপশিলিকরণের জন্য স্পেশাল সুবিধা দেওয়া হয়। কোনো উদ্যোক্তা তার খেলাপি ঋণ হিসাব পুনঃ তপশিলিকরণ করতে চাইলে এককালীন ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট আকারে জমা দিতে হয়। এরপর সেই ঋণ হিসাব এক বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য পুনঃ তপশিলিকরণ করা হয়েছে। ঋণ হিসাব পুনঃ তপশিলিকরণের এই বিধান বাতিল করা যেতে পারে। একই সঙ্গে কোনো ঋণ হিসাব পুনঃ তপশিলিকরণ করা হলে পুনঃ তপশিলিকরণের নির্দিষ্ট মেয়াদ শর্ত মোতাবেক সন্তোষজনকভাবে শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেই উদ্যোক্তা যাতে কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন করে ঋণ গ্রহণ করতে না পারে, তার বিধান করা প্রয়োজন।
ব্যাংক কোম্পানি আইন যতই সংশোধন বা হালনাগাদ করা হোক না কেন, তাতে কোনো কাজ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সৎ ও আন্তরিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন না করবেন। একজন ব্যাংক কর্মকর্তা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে আন্তরিকভাবে নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে তার পক্ষে কোনো ঋণপ্রস্তাব ভবিষ্যতে খেলাপি হতে পারে, তা চিহ্নিত করা অসম্ভব নয়।