মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প গত মঙ্গলবার আদালতে হাজির হয়েছেন। মার্কিন ইতিহাসে এই প্রথম এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ফৌজদারি মামলায় আদালতে একজন সাবেক প্রেসিডেন্টের হাজির হওয়ার আগে আমাদের ভয় পাওয়ার দুটি বড় কারণ ছিল।
প্রথমটি হলো, যখন ম্যানহাটনের জেলা অ্যাটর্নি অ্যালভিন ব্র্যাগের মামলাটি উপস্থাপিত হবে, তখন তার আইনি তত্ত্বটি খুব অস্পষ্ট ও জটিল বলে প্রমাণিত হতে পারে। অন্যটি হলো, ট্রাম্প এমন ক্রোধ ও উসকানি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবেন যে তিনি বিভক্ত একটি জাতির মধ্যে আরো গভীর বিভাজন তৈরি করবেন এবং নতুন অশান্তি সৃষ্টি করবেন, যা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও বিচারিক প্রতিষ্ঠানকে আরো ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এমন দুটি খারাপ পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হয়েছিল আরেকটি কারণে। তা হলো, এদিন ট্রাম্প একটি সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টিকে ‘পরাবাস্তব’ হিসেবে বর্ণনা করে উড়িয়ে দেন। এর ফলে আরেকটি ভয়াবহ, এমনকি দুঃখজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি হতে পারত। কেননা, ট্রাম্প আরেকটি তিক্ত নির্বাচনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
আমেরিকান আইনি ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিনগুলোর মধ্যে একটি ছিল এই দিন। এই বিস্ময় শুরু হয় তখন, যখন একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি তার শহরের আকাশচুম্বী বাড়ি ছেড়ে আদালতের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। এই শহরেই তিনি একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। পেয়েছেন সেলিব্রিটির তকমাও। আর এই শহর থেকেই তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়।
ট্রাম্প আদালতের দরজা দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে গেলেন এবং আঙুলের ছাপ নেওয়ার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হলো। এ সময় বিশ্বের একসময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির সংবাদ ফটোগ্রাফটা ছিল এরকম—বজ্রের মতো মুখ, অন্য কোনো আসামির মতো আইনজীবীদের সঙ্গে টেবিলে বসে আছেন। এটি তার অত্যাশ্চর্য অসম্মানের মুহূর্তকেই প্রতিফলিত করেছিল।
ট্রাম্প আদালতে নীরব ছিলেন। তিনি শুধু ‘নট গিলটি’ বা ‘অপরাধী নন’—এ কথা ছাড়া অন্য কিছু বলেননি এবং শুনানির পরে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাও বলেননি। কিন্তু যখন তিনি ফ্লোরিডায় তার গোল্ডেন লিভস রিসোর্টে স্ফটিক ঝাড়বাতিগুলোর নিচে কোর্টরুমের স্পার্টান সজ্জা অদলবদল করছিলেন, তখন তিনি একেবারে বিস্ফোরিত হয়ে উঠলেন। এ সময় তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘আমাদের দেশ জাহান্নামে চলে গেছে’। ষড়যন্ত্রতত্ত্বের সঙ্গে তার এই বিস্ফোরিত মন্তব্যে প্রসিকিউটরদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রসারিত হতে দেখা যায়।
এই মামলাগুলোর প্রতি তার ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। তিনি ২০২০ সালের জর্জিয়ার নির্বাচনে জো বাইডেনের জয় চুরি করার অভিযোগের ক্ষেত্রে পৃথক তদন্তের সময় প্রসিকিউটররা তার দুর্বলতা নিয়ে ক্রমবর্ধমানভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তার শ্রেণিবদ্ধ নথির মজুত এবং ৬ জানুয়ারি, ২০২১, বিদ্রোহের আগে তার আচরণ নিয়েও তারা ছিলেন চিন্তিত। তার বেশ কয়েকটি তদন্ত দৃশ্যত সমাপ্তির কাছাকাছি। এমন সম্ভাবনাও রয়েছে যে ট্রাম্প শিগিগরই আরো অভিযোগের মুখোমুখি হতে পারেন।
ম্যানহাটনের মামলার পরবর্তী শুনানি ৪ ডিসেম্বর। এবং তার বিরুদ্ধে অন্যান্য মামলা আরো গুরুতর। এতে সাংবিধানিক প্রশ্নও জড়িত। সম্ভবত এ কারণে এসব মামলা মঙ্গলবারের ঘটনাকেও অতিক্রম করে যেতে পারে। যেদিন একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হলো, সেই দিনটি সর্বদা স্মরণ করা হবে। তবে এটিকে ট্রাম্পের জন্য একটি ঐতিহাসিক পরিণতির চেয়েও একটি অশুভ প্রক্রিয়ার সূচনা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
ব্র্যাগের মামলাটি এই সরল ও গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তির ওপর নির্ভর করে যে কেউ, এমনকি একজন সাবেক রাষ্ট্রপতিরও আইনের ঊর্ধ্বে থাকা উচিত নয়। কিন্তু ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির সমালোচকেরা উদ্বিগ্ন এ কারণে যে, আরেকটি সমান ও বিরোধী নীতির খেলা চলছে। তা হলো :বিখ্যাত, ধনী ও শক্তিশালী কাউকে বিচারের মুখোমুখি করা যায় এবং একজন কম কুখ্যাত ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।
চার্জিং নথিতে বলা হয়েছে, ট্রাম্প ও তার তৎকালীন আইনজীবী মাইকেল কোহেন পর্ণো চলচ্চিত্র তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলস ও সাবেক প্লেবয় মডেল কারেন ম্যাকডুগালের পাশাপাশি ট্রাম্প টাওয়ারের একজন দারোয়ানকে অর্থ প্রদানের জন্য আমেরিকান মিডিয়া ইনকরপোরেটেডের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। চুপচাপ অর্থ প্রদান নিউ ইয়র্কের আইনে অবৈধ নয়। কিন্তু ব্র্যাগ একজন ডেমোক্র্যাট। তিনি অভিযোগ করেছেন যে ট্রাম্প অর্থ প্রদান লুকানোর জন্য ব্যাবসায়িক মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। সাধারণত এ ধরনের সীমালঙ্ঘন নিছক ফৌজদারি অপরাধ হবে। কিন্তু ব্র্যাগ পরামর্শ দেন, যদি এগুলো ২০১৬ সালের নির্বাচনি প্রচারণার সঙ্গে জড়িত অপরাধমূলক আচরণের প্রমাণ লুকানোর জন্য করা হয়, তবেই একটি অপরাধের অভিযোগ আনা যেতে পারে।
আদালতের নথিতে এবং কোহেনের সঙ্গে জড়িত পূর্ববর্তী এক মামলায় ট্রাম্পের আচরণ অবশ্যই নির্মম ছিল। কিন্তু কতিপয় আইনি বিশ্লেষক উল্লেখ করেছেন যে, ব্র্যাগের আইনি রোডম্যাপ ট্রাম্পের অ্যাটর্নিদের দ্বারা শক্তিশালী প্রাক-ট্রায়ালের গতির পথ খুলতে পারে।
এফবিআইয়ের সাবেক ডেপুটি ডিরেক্টর অ্যান্ড্রু ম্যাককের গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিএনএনকে বলেছেন, তার সহকর্মী প্রবীণ আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে ‘হতাশা’ ছিল। ব্র্যাগ জোর দিয়ে বলেছেন, যে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিচার না করার সিদ্ধান্ত আমেরিকান ন্যায়বিচারের প্রতিটি মূলনীতির বিরুদ্ধে যাবে।
ট্রাম্প আদালতে হাজির হওয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমরা গুরুতর অপরাধমূলক আচরণকে স্বাভাবিক করতে পারি না এবং করব না।’ তিনি বলেন, এজাতীয় ঘটনাগুলো অস্বাভাবিক নয়, তবে তার অফিসের কাজের ‘রুটি ও মাখন’। ব্র্যাগ বলেন, ‘এই মামলা আজ আমাদের অনেকগুলো হোয়াইট কলার মামলার মতো অভিযোগের মধ্যে একটি। আইনি মামলার আপাত জটিলতা আদালতে মীমাংসিত হবে। তবে এটিতে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও থাকবে। কেননা, ট্রাম্প একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির মর্যাদায় অভিষিক্ত এবং তিনি ২০২৪ সালে হোয়াইট হাউজে ফিরে যেতে চাইছেন।
যদি আইনজীবীদের পক্ষেও ব্র্যাগের মামলার পেছনে যুক্তি অনুসরণ করা কঠিন হয়, তবে অন্য সবার পক্ষে তা করা আরো কঠিন হবে। ব্র্যাগের অভিযোগটি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে প্রত্যাবর্তন করতে পারে এবং ট্রাম্পকে রাজনৈতিকভাবে উপকৃত করতে পারে—এমন ধারণা কিছু রিপাবলিকানও করছেন, যারা সাবেক রাষ্ট্রপতিকে সমর্থন করেন না। যেমন—ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন সিএনএনে উপস্থিত ছিলেন। ট্রাম্পের আরেক সমালোচক উটাহের সিনেটর মিট রমনিও এই মামলার সমালোচনা করেছেন।
রমনির বক্তব্য ছিল এমন—‘আমি বিশ্বাস করি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চরিত্র ও আচরণ তাকে পদের জন্য অযোগ্য করে তুলেছে। তবু আমি বিশ্বাস করি, নিউ ইয়র্কের প্রসিকিউটর রাজনৈতিক এজেন্ডা তৈরির জন্য অপরাধমূলক অপরাধের অভিযোগে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।’
‘তারা ব্যালট বাক্সে আমাদের মারতে পারে না, তাই তারা আইনের মাধ্যমে আমাদের মারতে চেষ্টা করে’—ট্রাম্প তার বক্তৃতায় এমন দাবিও করে। সাবেক রাষ্ট্রপতির যুক্তি গ্রহণ করা প্রায়শই কঠিন এবং তিনি তার বক্তব্যকে যুক্তিগ্রাহ্য করার জন্য কিছু শব্দ এমনভাবে চিত্কার করে উচ্চারণ করেন, যা তার ক্রোধই প্রকাশ করেছে। তার দাবি, তিনি রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার। ট্রাম্পের প্রতিভা হলো, তিনি তার লাখ লাখ সমর্থককে বোঝাতে পেরেছেন যে, গত নির্বাচনটি দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল।
কিছু রাজনৈতিক পণ্ডিত ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ট্রাম্পের অভিযোগ অন্তত স্বল্প মেয়াদে রাজনৈতিকভাবে তাকে সাহায্য করতে পারে। গত সপ্তাহে গ্র্যান্ড জুরি তাকে অভিযুক্ত করার জন্য ভোট দেওয়ার পর থেকে তার তহবিলে রাশি রাশি ডলার ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। জিওপি মনোনয়নের জন্য ট্রাম্পের বিরোধীরা এবং সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা যদি ট্রাম্পের ভিত্তিকে বিচ্ছিন্ন করা এড়াতে চান, তবে ব্র্যাগকে তার ক্রিয়াকলাপের জন্য লাইনে দাঁড়ানো এবং সমালোচনা করা ছাড়া খুব কম বিকল্প ছিল। অতীতে দেখা গেছে, ট্রাম্প যত বেশি চরমে উঠবেন, তৃণমূল ভোটারদের কাছে তিনি তত বেশি জনপ্রিয় হবেন। তবে অতীতেও সাবেক রাষ্ট্রপতির জন্য কম অনুকূল রাজনৈতিক শিক্ষণীয় বিষয় ছিল না। মঙ্গলবার রাতে একটি প্রাইমটাইম টেলিভিশন দর্শকদের কাছে তিনি যে চরমপন্থা প্রদর্শন করেন, তা ঠিক সেই উগ্রবাদের ব্র্যান্ড, যা ২০২০ সালের নির্বাচনে এবং ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানদের হতাশাজনক সমাপ্তি ও পরাজয়ে অবদান রাখে।