বন্যার সঙ্গে এই বদ্বীপের সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই। দেশের পানি বিশেষজ্ঞদের মতামত, ‘বন্যা না হলে তো বাংলাদেশ হতো না। ’ বাংলাদেশের অবস্থানটা এমন স্থানে যে এতদঞ্চলে বন্যার প্রবণতা রয়েছে। পাশাপাশি এ দেশের মধ্য দিয়ে প্রবহমান ছোট-বড় ২৩০টি নদী।
বিভিন্ন কারণে এগুলোর নাব্যতা হ্রাস, হিমালয়ের বরফগলা, উজানের দেশগুলো থেকে নেমে আসা বৃষ্টি আর মানবসৃষ্ট বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণেই এ বন্যা বিপর্যয়।
এ ভূখণ্ড ব্রিটিশদের দখলের পর ১৭৬৭ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে বন্যার তথ্য পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে বন্যা নিয়ে মহাভারত, রামায়ণ ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থে লেখা রয়েছে। ৩২১-২৯৬ খ্রিস্টপূর্বে চন্দ্রগুপ্তের আমলে এবং ৫০৭-৫৮৭ খ্রিস্টাব্দের আগে জ্যোতির্বিদ আর্যভট্টের লেখায় এ এলাকার বন্যার আভাস রয়েছে। এই বঙ্গে ১৮৭০-১৯২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অধ্যাপক পিসি মহলানবীশ প্রকাশ করেন যে এখানে দুই বছর পর পর মাঝারি এবং ছয়-সাত বছর অন্তর বড় ধরনের বন্যা দেখা দিত। এমনকি এ সময় বন্যার কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের পুরনো গতিপথের পরিবর্তন ঘটে। এ দেশে বন্যার দাপটের শুরু মূলত ১৯৫৪ সাল থেকে। ১৯৫৪-৯৮ সাল পর্যন্ত তিন যুগে প্রায় ৩২ বার বড় আকারের বন্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঠিক আগে ১৯৭০ সালে রয়েছে প্রলয়ংকরী বন্যার দুঃসহ স্মৃতি। এ বছরের বন্যায় প্রাণহানি ঘটে পাঁচ লাখ মানুষের। খাদ্যশস্য নষ্ট হয় প্রায় ১৩ লাখ টন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২, ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৮ ও ২০১৭ সালে দেশজুড়ে বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এসব বন্যায় দেশের ২০-৬০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হতে দেখা যায়। বন্যায় ঘরবাড়ি, গবাদি পশু, কৃষিপণ্য, মৎস্য খামার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সব সামাজিক সরবরাহ, সেতু-কালভার্টসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় হাজার হাজার কোটি টাকা।
বন্যার কারণে দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা, পয়ো ও পানি নিষ্কাশন এবং সুপেয় পানির অভাব, খাদ্যসংকট, পরিবেশদূষণ, সাপ ও নানা ধরনের বিষাক্ত প্রাণী ও মশা-মাছির উপদ্রবসহ নানা কারণে জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। পানি ও খাদ্যবাহিত রোগ, যেমন—ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস ও পেটের পীড়া প্রভৃতি ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। পরিবেশদূষণের কারণে জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, নানা ধরনের চর্মরোগ, কনজাংটিভাইটিসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বন্যার সময় প্রায়ই পানিতে ডুবে বা বিদ্যুতায়িত হয়ে কিংবা সর্প দংশনে মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায় অনেক মানুষকে।
বন্যার কারণে সৃষ্ট রোগের বেশির ভাগই হয়ে থাকে পানি ও খাবার থেকে। এ সময় কষ্ট হলেও বন্যার পানি পান পরিহার করতে হবে। সম্ভব হলে আধাঘণ্টা ফুটিয়ে পান করতে হবে, ফোটানো সম্ভব না হলে ১০ লিটার পানিতে দুটি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট (হ্যালোজেন ট্যাবলেট) আধাঘণ্টা মিশিয়ে রাখলেই ওই পানি পানের উপযোগী হবে।
পচা ও বাসি খাবার গ্রহণ পরিহার করতে হবে, খাবার সব সময় ঢেকে রাখতে হবে। তাহলেই কলেরা বা ডায়রিয়া জীবাণু বহনকারী মাছি বা মশা এসব রোগ ছড়াতে পারবে না। বাসস্থানের আশপাশে মলমূত্র ত্যাগে বিরত থাকতে হবে। এ সময় অবশ্যই সাবান, ছাই বা মাটি দিয়ে হাত পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
বন্যাকালে বেশির ভাগ সময় পানির সংস্পর্শে থাকার ফলে শরীরে খোসপাঁচড়া, ফাঙ্গাসের সংক্রমণ বা স্ক্যাবিসজাতীয় চর্মরোগ দেখা দিতে পারে, তাই যতটা সম্ভব শরীর শুকনা রাখতে হবে। অনেক শিশু সাঁতার না জানার কারণে এবং বৃদ্ধরা এ সময় পানিতে ডুবে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তাই তাদের দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে।
এ সময় সাপ ও ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে যায়। বাসস্থানের চারদিকে কার্বলিক এসিড রেখে দিলে সাপের উপদ্রব হ্রাস পায়। সাপ বা ইঁদুর কামড়ালে দ্রুত স্থানীয় মেডিক্যাল টিম বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডায়রিয়া বা কলেরা আক্রান্ত রোগীকে পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইন বা ভাতের মাড় খাওয়ালে শরীরের পানিশূন্যতা কমবে। পাশাপাশি তাদের স্থানীয় মেডিক্যাল টিম বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা এড়াতে পারতপক্ষে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখাই শ্রেয়। সংযোগ চলাকালে বিশেষ সতর্কতা জরুরি।
বন্যা-পরবর্তী সময়ে বাড়িঘর, পয়োনিষ্কাশনসহ বাড়ির আঙিনা ও আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে। মৃত ও পচা জীবজন্তু মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। বন্যায় ডুবে যাওয়া টিউবওয়েলের মূল অংশ খুলে পাইপের পানিতে ০.০৫ শতাংশ ব্লিচিং দ্রবণ ঢেলে, আধাঘণ্টা পর মূল অংশ পুনঃস্থাপন করে ১৫-২০ মিনিট ধরে চেপে পানি বের করে ফেললেই টিউবওয়েলের পানি পানের উপযোগী হয়ে যাবে।
প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম একটি বন্যাপ্রবণ দেশ। আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে সমন্বিত উদ্যোগ; নদী ও পানি সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতা বন্যার ভয়াবহতা অনেকটাই হ্রাস করা সম্ভব। পাশাপাশি বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী সময়ের দুর্যোগ প্রতিরোধ, ক্ষয়ক্ষতি প্রশমন ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা যাতে ভেঙে না পড়ে সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।