সাবেক পর্নো তারকাকে ঘুষ দেওয়ার মামলায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম দিনের শুনানি শেষে আবারও নিউ ইয়র্ক থেকে ফ্লোরিডায় ফিরে গেছেন। এ মামলায় আগামী ৪ ডিসেম্বর পরবর্তী শুনানি হবে। গত মঙ্গলবার প্রথম দিনের শুনানির পর ম্যানহাটনের ফৌজদারি আদালত এ তারিখ নির্ধারণ করেন। কৌঁসুলিরা বলছেন, আগামী ৬৫ দিনের মধ্যে আদালতে তদন্তের বিস্তারিত উপস্থাপন করতে পারবেন বলে আশা করছেন তারা। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০০৬ সালে স্টরমি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে তার যৌন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পরে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে মুখ না খুলতে তার পক্ষ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দেওয়া হয়েছিল ড্যানিয়েলসকে। তিনিই প্রথম কোনো সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছেন। গত মঙ্গলবার ম্যানহাটনের ফৌজদারি আদালতে আত্মসমর্পণের পর ট্রাম্পকে গ্রেফতার করে আদালতে তোলা হয়। বিচারপতি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা ৩৪টি অভিযোগ পড়ে শোনান। ট্রাম্প অবশ্য অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন।
ট্রাম্পের সাবেক আইনজীবী মাইকেল কোহেন এই হাসমানির টাকা স্টর্মি ডানিয়েলকে প্রদানের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নির্বাচনি আইন ভেঙে দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেল খেটেছেন। ইতিপূর্বে প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার কেলেঙ্কারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার আগেই তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড কর্তৃক অগ্রিম ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। নিক্সনের পূর্ববর্তী ভাইস প্রেসিডেন্ট স্পিরো এগনো দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলেও প্রসিকিউশনের সঙ্গে প্রি ডিলে (সমঝোতা বলে) জেলসাজা মওকুফ পেয়েছিলেন। এরন বার নামে আরেক সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট দেশদ্রোহের মামলা থেকে অব্যাহতির শর্তে দেশত্যাগ করেছিলেন।
২০২৪ সালের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কংগ্রেস কর্তৃক দুই বার অভিশংসিত ডোনাল্ড ট্রাম্প বিরাট তোড়জোড়ে সার্বিক প্রচারণা শুরু করেছেন। যদিও রিপাবলিকান দলের প্রাইমারি ইলেকশনেও তাকে দল থেকে জয়ী হয়ে আসতে হবে। প্রথম বারের মতোই তাকে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখামুখি হওয়া লাগতে পারে। ২০১৬ সালের রিপাবলিকান দলের প্রাইমারিতে প্রায় ২০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও এবার সে সংখ্যাটা হয়তো হবে চার বা পাঁচ। তাই এবার প্রাইমারিতে অত সহজে পার পাওয়া যাবে বলে মনে করা হবে ভুল। এ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী তালিকায় পাঁচ-ছয় জনের নাম ঘোষিত হলেও, আলোচনায় এগিয়ে আছেন, ট্রাম্প, ফ্লোরিডার গভর্নর অপেক্ষাকৃত বয়সে তরুণ ডি শেন্টোস, তারই সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত এরিজোনার সাবেক গভর্নর, ট্রাম্পের নিয়োজিত সাবেক জাতিসংঘের দূত নিকি হেইলির নাম উল্লেখযোগ্য। তবে এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, প্রার্থী যে-ই হোক, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ট্রাম্পের সঙ্গেই হবে বা তিনিও শেষ পর্যন্ত আবার চূড়ান্ত প্রার্থী হতেও পারেন।
মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ট্রাম্প, মাইক পেন্স ও ডি সেন্টিসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের প্রার্থিতা নির্ধারণের ভাগ্য তার বিরুদ্ধে পরিচালিত তিনটি মামলার কার্যক্রম, ইন্ডাইক্টমেন্ট ও চূড়ান্ত পর্যায়ের বিচার শেষে শাস্তিপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বর্তমানে নিউ ইয়র্কের ডিস্ট্রিক অ্যাটর্নি অফিস পর্নো তারকা স্টর্মি ডানিয়েলকে টাকা দিয়ে তার মুখ বন্ধ রাখাসংক্রান্ত হাসমানি পেমেন্ট মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্র্যান্ড জুরি ইন্ডাইক্টমেন্ট হয়ে বিচার শুরু হওয়ার পথে। ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটাল হিল আক্রমণ করে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রেসিডেন্ট হওয়া ও শপথগ্রহণ বানচাল করতে, ক্যাপিটাল পুলিশ হত্যা ও আঘাত করার অপরাধে ও ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট মিসহ্যান্ডলিং করা সংক্রান্ত জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট আরও একটি মামলা পরিচালিত করছে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বা কাউন্সিল নিয়োগ দানের মাধ্যমে।
পাশাপাশি জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ফুলটন কাউন্টি প্রসিকিউটর অফিসও ২০২০ সালের নির্বাচনি ফলাফল পরিবর্তন করার অপরাধে তৃতীয় ও শক্তিশালী মামলাটি তদন্তও এগিয়ে চলছে দ্রুত গতিতে। পর্নো তারকাকে নির্বাচনি বাজেট থেকে টাকা দেওয়ার হাসমানি পেমেন্ট মামলা ছাড়াও ক্যাপিটাল হিল আক্রমণ ও ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট মিসহ্যান্ডলিং-সংক্রান্ত মামলা ও জর্জিয়ার নির্বাচনি ফলাফল জোর করে পাঠিয়ে দেওয়ার অপরাধের মামলা, এই তিনটি মামলার বিচার ও তদন্তও চলছে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বা স্পেশাল কাউন্সিলের অধীনে গ্র্যান্ড জুরি ট্রায়ালের মাধ্যমে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন তার নির্বাচনি প্রচারণা, তহবিল আহরণের কাজ জোরেশোরে শুরু করছেন, তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগসমূহকে যখন রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে তার নির্বাচনি হাওয়াকে পক্ষে আনতে চাইছেন, পাশাপাশি বেশ কয়েকটি আপিল আদালতের সিদ্ধান্ত তার সেসব যুক্তি ও কথামালার বিপক্ষে যাচ্ছে, তাকে আরও সমূহ চ্যালেঞ্জের মুখে পতিত করছে। যেমন, সম্প্রতি ডিসি আপিল আদালত তার প্রেসিডেন্সিয়াল প্রিভিলিজ-সংক্রান্ত মামলায় তার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, সাবেক চিফ অব স্টাফ মার্ক মেডো, চিফ নিরাপত্তাবিষয়ক অ্যাডভাইজারসহ দশের অধিক ব্যক্তিকে ক্রিমিনাল তদন্তের গ্র্যান্ড জুরির জিজ্ঞাসাবাদের সেশনে অংশগ্রহণ করে জিজ্ঞাসাবাদের উত্তর দিতে নির্দেশ দিয়েছে।
রিপাবলিকান প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাইমারি নির্বাচনের জরিপে ট্রাম্প এখনো লিডিংয়ে আছে। এতগুলো তদন্তাধীন ক্রিমিনাল মামলা ও ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটাল হিল আক্রমণের ঘটনা সত্ত্বেও জরিপে এগিয়ে থাকায় ট্রাম্প এখন আলোচনার শীর্ষেই অবস্থান করছেন। আলোচ্য মামলাসমূহের চূড়ান্ত বিচারে ট্রাম্প দোষী প্রমাণিত বা সাব্যস্ত হয়ে সাজাপ্রাপ্ত হলে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি আদৌ প্রার্থী হতে পারবেন কি না বা হয়ে নির্বাচনে জিতে আদৌ প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন কি না, এসব বিষয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন।
সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে একজনকে আমেরিকার জন্মগতভাবে ৩৫ বছর বয়সের নাগরিক হতে হয়, কমপক্ষে ১৪ বছর স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বসবাস করতে হয়। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির ল প্রফেসার জন হেনসেনের মতে ট্রাম্প সাধারণ অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে দণ্ডিত হলেও নির্বাচনে প্রার্থী হতে কোনো বাধা থাকবে না, যদি না তিনি দেশদ্রোহিতা, অবৈধভাবে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র, নির্বাচনি আইন ভঙ্গ করে ফেডারেল আইন লঙ্ঘনের কোনো অপরাধ না করেন।
সংবিধানের ১৪ ও ২২তম সংশোধনী মোতাবেক দুটি বিষয়ে, যেমন—এক. অভিশংসন (সিনেট ও হাউজে) ও দুই. হাই মিসডোমিনার ক্রাইম ও দেশদ্রোহিতা ও ইনসারকশনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বা সাজাপ্রাপ্ত হলেই কেবল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে অযোগ্য হতে পারেন। নির্বাচন যেহেতু সন্নিকটে আর এ ধরনের মামলার বিচারকাজ এখনো যেহেতু শুরুই হয়নি, তাই নির্বাচনে প্রার্থী হতে আপাতত কোনো বাধা থাকছে না। তবে জনগণের ভোট আদায়ে অবশ্যই সমস্যা হবে। মামলাসমূহের বিচারের রায়ের পর দীর্ঘ আপিল শুনানির সুবিধা তো আছেই।
পর্নো তারকা স্টর্মি ডানিয়েলের হাসমানি মামলা ও মার লাগোর ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট-সংক্রান্ত মামলা দুটির কোনোটাই রিবেলিয়ান বা ইনসারকসেন-সংক্রান্ত নয় বলে এ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হলেও নির্বাচনে প্রার্থী হতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। তবে জর্জিয়ার নির্বাচনি ফলাফল পালটে দেওয়া বা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদান ও ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটাল হিল আক্রমণ-সংক্রান্ত মামলায় রিবেলিয়ান বা দেশবিরোধী, সংবিধানবিরোধী বলে বিবেচিত হতে পারে। এক্ষেত্রেও নিকটবর্তী নির্বাচনের বেলায় তার যে কোনো সাজাপ্রাপ্তির বিরুদ্ধে আপিল করার সুবিধা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার করতে কোনোই সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে নির্বাচনের পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল শুনানি ও রায়ে সাজাপ্রাপ্ত হলে তার ওপর ভিত্তি করে তার কাজ পরিচালনার পরবর্তী ভাগ্য নির্ধারিত হবে।
মিসডিমিনার অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হলে সাজা খাটার দুই বছর পর্যন্ত ভোট দেওয়ার অধিকার হারাতে পারেন ফ্লোরিডায়। যেহেতু নির্বাচন এখন অতি সন্নিকটে এবং সাজা ঘোষণার পর আপিল শুনানির বিষয়টাও দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার তাই আপাতত ট্রাম্পের ঐ ভয়ে ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাই বলা যায়, বর্তমানে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র বাধা হতে পারে তার বিরোধী অন্য কোনো রিপাবলিকান প্রার্থী হতে পারেন ফ্লোরিডার গভর্নর জন সেন্টোস, মাইক পেন্স বা অন্য কেউ। মামলাসংক্রান্ত কোনো সাজা আপাতত তাকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখতে পারবে না।