প্রকাশ্যে না হলেও একটা ‘গোপন’ লড়াই সবসময়ই চলে। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে। ক্রিকেট বনাম অন্যান্য খেলা। আরও স্পষ্ট করে বললে ক্রিকেট বনাম ফুটবল। ক্রীড়াপ্রেমী মানুষের কথা যদি টানা যায়, সেখানেও আছে বিভক্তি। ক্রিকেটই নাকি দেশের ফুটবলের ধ্বংসের কারণ! অনেকেই মনে করেন, ক্রিকেটের জোয়ারে ভাটা পড়েছে ফুটবলে। ‘আড়ালের’ সেই লড়াই কি এবার প্রকাশ্যে এলো! বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি সালাউদ্দিন ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কথায় লড়াই আমলে নিলে দুয়ে দুয়ে তো চার মেলানোই যায়!
শুরু থেকে শুরু করা যাক। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল অলিম্পিক বাছাইয়ে যেতে পারেনি। কারণ বাফুফের টাকা নেই। অথচ এই দলটিই গত বছর সাফ জিতে উৎসবের রঙিন হাওয়া বইয়ে দিয়েছিল গোটা দেশে। টাকার অভাবে নারী দলের মিয়ানমার-যাত্রা বাতিল হওয়ার ব্যাখ্যা দিতে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন বাফুফে সভাপতি সালাউদ্দিন। গত ৩ এপ্রিলের ওই সংবাদ সম্মেলনে বাফুফে সভাপতির কাছে প্রশ্ন ছিল, বিসিবি সভাপতি খেলা চলাকালেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করেন। সেখানে বাফুফে সভাপতি কেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি, কেন এই দূরত্ব? উত্তরে সালাউদ্দিন বলেছিলেন, ‘সবার ব্যক্তিত্ব তো এক না। আমি তো লোক দেখিয়ে বলবো না- এই প্রধানমন্ত্রী ফোন দিয়েছে। আমি ওই রকম না। আমি ফুটবল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছি। আমি ওই নাটক করতে পারবো না। আমি প্রধানমন্ত্রীকে শ্রদ্ধা করি। আমি লোক দেখাতে পারবো না।’
কথাটা যে পাপনকে উদ্দেশ্য করে সালাউদ্দিন বলেছিলেন, সেটা বুঝতে বাকি থাকে না। কারণ বিসিবি সভাপতিকে উদাহরণ টেনেই তো সালাউদ্দিনকে প্র্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকরা। এ ব্যাপারে পাপনের বক্তব্য কী, কৌতূহল ছিল ক্রীড়াপ্রেমীদের। সেই সুযোগ সংবাদমাধ্যম পেয়ে যায় শুক্রবার (৭ এপ্রিল) বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড টেস্ট শেষে।
মিরপুরে বাফুফে সভাপতির বক্তব্য সামনে তুলতেই পাপন বলেছেন, ‘দেখেন, সাধারণ একটা জিনিস। প্রথম কথা হচ্ছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ফোন করলে আমি যেখানেই থাকি, যে অবস্থায় থাকি ফোন ধরবোই। আমি জানি না এটা নিয়ে কেন বলেছে। এ নিয়ে আমি মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।
বরং পাপন সাংবাদিকদের দিকেই আঙুল তুললেন, ‘আমার মনে হয় সমস্যাটা আপনাদের, আপনারা এত বাজে প্রশ্ন করলেন কেন? আপনারা হিসাব চাচ্ছেন, টাকা কী করেছে? এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে যান কেন?’ তবে বিসিবি সভাপতি এই কথার মাধ্যমে যে সালাউদ্দিনকে মৃদু খোঁচা মারলেন, সেটি বোঝা যায় তার পরের কথায়, ‘এটা করলে তো উনার (সালাউদ্দিন) মাথা খারাপ হবে, এটা সবাই জানেন। এমন প্রশ্ন করেন কেন। করলে মাথা ঠিক থাকবে?’
তারপরও বাফুফে সভাপতি যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি কি ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়? নিশ্চয় খারাপ লেগেছে পাপনের? উত্তরটা বিসিবি প্রধানের মুখেই শুনুন, ‘সব জায়গাতেই সব রকমের জিনিস আছে। যেমন ধরেন ব্যাকগ্রাউন্ড। এখন সব ফুটবলার কিংবা সংগঠকের ব্যাকগ্রাউন্ড মানেই কী নির্লজ্জ, বেহায়া, অহংকারী? এটা তো বলা যাবে না। এটা ব্যক্তির ব্যাপার। তবে আপনাদের এসব প্রশ্ন না করাই ভালো। আমার এগুলো নিয়ে মন খারাপ হয়নি, প্রশ্নই উঠে না, মন খারাপ হওয়ার কিংবা চিন্তা করার। কে বলছে সেটা আসলে বড় কথা। এ ধরনের লোক (সালাউদ্দিন) বললে কিছু যায়-আসে না।
যার কথা বলেছেন পাপন, সেই সালাউদ্দিন আগের সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, তাকে ফোন দিয়ে ‘ধমক’ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নারী দলকে মিয়ানমার পাঠাতে না পারায় অসন্তুষ্ট হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেটি সংবাদমাধ্যমে বাফুফে প্রধান বলেছেন এভাবে, “আমাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ফোন করা হয়েছিল। ওনারা দুটো বিষয় জানতে চান। প্রথমত বলেছেন, কত টাকা লাগবে এখনই তা জানাতে। আমাকে ধমক দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সালাউদ্দিন, আমাকে কেন বলোনি?’ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘কত টাকা লাগবে নিয়ে যাও।
পাপনও প্রায় একই কথা বলেছেন। ফুটবলের কর্তাব্যক্তিদের একহাত নিয়েছেন এই বলে, ‘যেটা গুরুত্বপূর্ণ, মেয়েরা যেতে পারলো না। মাত্র ২০ লাখ টাকার জন্য (আসলে ৬০ লাখ)। এর চেয়ে দুঃখের, কষ্টের কী আছে প্রধানমন্ত্রী কী কষ্টটাই না পেয়েছেন। আপনারা চ্যানেলগুলো আছেন না, যে কোনও চ্যানেলের মালিকের কাছে গিয়ে বললেই দিয়ে দিতো। একজনের কাছে বলতে তো হবে।
যেকোনো ক্রিকেটার কিংবা বোর্ড পরিচালকের কাছে চাইলেও নাকি টাকা পেয়ে যেত বাফুফে! পাপনের ভাষায়, ‘বিশ্বাস করেন আমি কারও সঙ্গে কথা বলিনি, আমাদের খেলোয়াড়রা (ক্রিকেটার) দিয়ে দিতো। খালি বলতো একবার। এ কী! এত গোপনে জিনিসটা রেখে, যে প্রক্রিয়ায় করেছে এটা খুব দুঃখজনক। আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ে ফুটবল ফেডারেশনে যে পরিচালকরা আছে, অবিশ্বাস্য। তারা কি ২০ লাখ টাকাও দিতে পারে না?
সর্বোপরি নারী ফুটবলের দলের অলিম্পিক বাছাইয়ে যেতে পারা পাপনের কাছে ‘লজ্জার’। বিশেষ করে, টাকার অভাবের বিষয়টি মানতেই পারছেন না তিনি, ‘আমার মনে হয় অন্য কিছু আছে। আমি জানি না। এটা দুঃখজনক। দেশের জন্য এর চেয়ে বড় বদনাম হতে পারে না। আমরা বলছি দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সারা পৃথিবী মেনে নিচ্ছে। সে জায়গায় আমরা বলছি ২০ লাখ (আসলে ৬০ লাখ) টাকার জন্য আমাদের দেশের মেয়েরা প্রি-অলিম্পিক খেলতে যেতে পারে না। এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর হয় না। এজন্য এই টপিক নিয়ে কথা বলতে চাই না। এদের সঙ্গে কথা বলার কোনও প্রশ্নই আসে না।
টাকার অভাবে মেয়েদের অলিম্পিক বাছাইয়ে যেতে না পারার এই ইস্যুতে, দেশের ফুটবল ও ক্রিকেটের দুই প্রধানের কথার লড়াই উত্তাপ ছড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক বিশেষ সহকারী শাহ আলি ফরহাদ যেমন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ক্রিকেট ও ফুটবলে বাংলাদেশের দরকার নতুন ক্ষমতা। ক্রিকেট ও ফুটবল দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের নতুন শীর্ষ কর্তাদের প্রয়োজন। নাজমুল হাসান পাপন ও কাজী সালাউদ্দিন দুজনেই যথাক্রমে ক্রিকেট ও ফুটবলের জন্য অনেক কিছু করেছেন।
পোস্টের পরের অংশে লিখেছেন, ‘ডার্ক নাইটে যেমন হার্ভে ডেন্ট বলেছিলেন, হয় আপনি নায়ক হয়ে মারা যাবেন কিংবা নিজেকে ভিলেন দেখার জন্য বেঁচে থাকবেন। দুই ভদ্রলোকই (পাপন ও সালাউদ্দিন) সেই ঘটনার দিগন্তে পৌঁছে গেছেন। তাদের অবদান রাখার মতো নতুন কিছু নেই এবং তাদের অহংকার খেলার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে। সময় এসেছে তাদের পরিষেবার জন্য ধন্যবাদ ও বিদায় জানানোর। সময় হয়েছে নতুন ধারণার নতুন মুখের।
সেটি হয়তো সময়ই বলে দেবে! তবে টাকার অভাবে নারী দলের অলিম্পিকের মতো বড় আসরের বাছাইয়ে যেতে না পারা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য বড় ধাক্কাই। ঠিক সেই পরিস্থিতিতেই ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় দুই খেলার সর্বোচ্চ কর্তাদের কথাই লড়াই ভালো ইঙ্গিত দেয় না