সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আগে তৃণমূলকে শক্তিশালী করতে চায় বিএনপি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবিতে তিন-চার মাসের মধ্যেই এক দফা আন্দোলনে যাবে দলটি। বিগত দুই নির্বাচনের আগে ‘ব্যর্থ আন্দোলনে’র অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখেই আন্দোলনের রোডম্যাপ সাজাচ্ছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দলটি। এবার ‘সফল’ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে আবারও তৃণমূলে ফিরেছে দলটি। মাঠ পর্যায়ে দলকে গোছাতে গ্রহণ করেছে নানামুখী উদ্যোগ। তার অংশ হিসেবে আজ শনিবার সারাদেশের মহানগরীর সব থানা এবং উপজেলায় দুই ঘণ্টা যুগপৎ অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি।
দলীয় সূত্র জানায়, নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি প্রমাণে এবং নেতাকর্মীকে চাঙ্গা রাখতে একযোগে এ কর্মসূচি পালন করছে দলটি। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সরকারের দুর্নীতির প্রতিবাদ এবং পদত্যাগসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ১০ দফা দাবিতে বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত এই কর্মসূচি পালন করবে তারা। সমমনা অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং জোটও আজ এ কর্মসূচি পালন করবে। পাশাপাশি প্রতিটি বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে ইফতার মাহফিলের মতো নিয়মিত কর্মসূচি পালন করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। পবিত্র রমজান মাসের পর সরকারবিরোধী আন্দোলনকে আরও জোরদার করার নানা পরিকল্পনা করছে বিএনপিসহ বিরোধী সমমনা দলগুলো। তৃণমূলে দল ও অঙ্গসংগঠনের মেয়াদোত্তীর্ণ ও আহ্বায়ক কমিটিও সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দেশের এই ক্রান্তিকালে তাঁরা জনগণের অধিকার ও দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলন শুরু করেছেন। এই আন্দোলনে জনগণ নেমে এসেছে। তাদের সমর্থন নিয়ে তৃণমূল থেকে পর্যায়ক্রমে এই আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার দাবি না মানলে তৃণমূল থেকে আন্দোলন ধাপে ধাপে আগামীতে রাজধানীতে বড় কর্মসূচি দেওয়া হবে।
আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ ১৩টি মহানগরীর ১২৮টি থানায় এবং সাড়ে ৫০০ উপজেলা মিলে প্রায় সাড়ে ৬০০ স্থানে একযোগে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হবে। কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, দলের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলার শীর্ষস্থানীয় নেতারা অংশ নেবেন। ইতোমধ্যে নেতাদের দায়িত্ব ভাগ করে টিম গঠন করা হয়েছে।
বিএনপির চলমান কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামী ১০ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত সব বিভাগের ইউনিয়ন পর্যায়ে অবস্থান কর্মসূচি, মানববন্ধন ও প্রচারপত্র বিলির কর্মসূচি রয়েছে। বিকেল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ইউনিয়ন পর্যায়ে অবস্থান কর্মসূচি সমন্বয়ের জন্য বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর আগে ১ এপ্রিল রাজধানীসহ সব মহানগর ও জেলা সদরে দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা যুগপৎ অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বিএনপি।
দলের এক বিজ্ঞপ্তিতে বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সব জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা ও পৌরসভা ইউনিটকে ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মসূচি সফল করতে প্রস্তুতি সভা, কর্মিসভা, গণসংযোগ জোরদার করার আহ্বান জানানো হয়েছে। পৌর ইউনিটের নেতাকর্মীকে উপজেলার কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে বলা হয়েছে।
দলটির ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রায় প্রতিদিনই বৈঠক করছেন, ঘরোয়া প্রস্তুতি সভা করছেন, মতবিনিময় সভা করছেন নেতাকর্মীরা। আগামীতে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের আগে নিজেদের প্রস্তুতিপর্ব সম্পন্ন করতে নেওয়া হচ্ছে নানান পরিকল্পনা। একদিকে সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি, অন্যদিকে জনমত বাড়াতে ও নিজেদের পক্ষে রাখতে ইস্যুভিত্তিক মাঠে থাকার পরিকল্পনা রয়েছে। এর আলোকে রমজান মাসের মাঝের ১০ দিন কর্মসূচি নিয়ে তৎপর দলটি। এর পরে বিরতি দিয়ে ঈদের পর নতুনভাবে সমমনা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে রাজপথে নামার সিদ্ধান্ত রয়েছে।
কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, সারাদেশে নেতাকর্মীর মনোবল চাঙ্গা রাখতে, তাঁদের সক্রিয় করতে এবং আন্দোলনে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে তাঁরা ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছেন। আজকের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সারাদেশে থানা-উপজেলা পর্যায়ে নিজেদের শক্তিমত্তা পরীক্ষা করতে চাচ্ছে দলটি। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে মূল দলের পাশাপাশি অঙ্গসংগঠনও একযোগে মাঠে নামবে।
বিএনপির নেতারা জানান, শুধু দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা নয়, অন্যান্য দলের মতামত, তাদের চাওয়া-পাওয়াকে সমন্বয় করা হচ্ছে; সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন পেশাজীবী, কূটনৈতিক মহল, প্রশাসনসহ সব জায়গায় তাঁরা কাজ করছেন। এসব ‘জায়গা’ আন্দোলনের অনুকূলে আনতে পারলেই এক দফার আন্দোলনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। এজন্য রোজার মধ্যেও ধারাবাহিক আন্দোলন চলমান রাখা হয়েছে।
দলের নেতারা আরও জানান, সারাদেশে তৃণমূলের ইউনিয়ন থেকে বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। ওই সব কর্মসূচিতে দলের নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। প্রশাসন ও সরকারি দলের হামলা-বাধা, মামলা ও গ্রেপ্তারকে মোকাবিলা করে যেভাবে কর্মসূচি সফল করা হয়েছে তাতে তাঁরা আশান্বিত। ওই সব কর্মসূচি ছিল সমন্বিতভাবে। দলের প্রতিটি স্তরের নেতাকর্মীর অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। এবারও এর প্রতিফলন দেখতে চাচ্ছেন দলের হাইকমান্ড। নিজেদের সাংগঠনিক সক্ষমতা ও শক্তিমত্তা প্রমাণ করতে দলের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দলের একজন স্থায়ী কমিটির নেতা জানান, সারাদেশে থানা-উপজেলা পর্যায়ের এ কর্মসূচিতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মহানগরের থানাভিত্তিক কর্মসূচিকে। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু মহানগরকে ঢেলে সাজানোর জন্য, আন্দোলন উপযুক্ত করে তোলার জন্য তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। যার সুফল পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এটাকে তাঁরা আরও শক্তিশালী করতে চাচ্ছেন। মহানগরকেন্দ্রিক তৃণমূলকে আবারও একটি ঝাঁকুনি দিতে চান তাঁরা। চলমান আন্দোলনে যেসব স্থানে দুর্বলতা পাওয়া যাবে, তা চিহ্নিত করে সংগঠনকে আরও শক্তিশালী ও আন্দোলনমুখী করা হবে।
দলীয় সূত্র জানায়, আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপিকে আরও বেশি সক্রিয় করতে দেওয়া হচ্ছে কঠোর নির্দেশনা। এ দুই ইউনিটের একেবারে তৃণমূল থেকে নেতাকর্মীকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় এবার থানায় থানায় অবস্থান কর্মসূচিকে গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে।
মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক জানান, দেশকে স্বৈরশাসনমুক্ত করতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছেন নেতাকর্মীরা। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ভোটাধিকার ও মানবাধিকার ফিরিয়ে আনা এবং খালেদা জিয়াসহ সব নেতাকর্মীর মুক্তির জন্য ওই আন্দোলনে তাঁরা জীবন বাজি রাখতে চান।
মাঠের আন্দোলনের পাশাপাশি নেতাকর্মীকে উজ্জীবিত রাখতে সারাদেশে শতাধিক ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছে দলটি। দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের ব্যানারেও চলছে এ আয়োজন। এর মাধ্যমে সরকারের দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচারসহ অন্যান্য অসংগতি তুলে ধরা হচ্ছে। এসব ইফতার মাহফিলে দলের নেতাকর্মী ছাড়াও পেশাজীবী, সর্বস্তরের সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।