সমাজে দিনে দিনে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বেড়েই চলেছে। অপরাধ সংঘটনের জন্য অধুনা অপরাধীরা উন্নত হাতিয়ার ও কৌশল ব্যবহার করছে। তদুপরি সময়ের সঙ্গে অপরাধের ব্যাপ্তির ক্রমবর্ধমান প্রবণতা, সেই সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে অপরাধ সংঘটনের ধরন ও কৌশল বদলাচ্ছে—এখন অপরাধ হচ্ছে ডিজিটালাইজড উপায়ে। ফরেনসিক বিজ্ঞান আইনগত বিষয়ে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তথা রসায়নবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, কম্পিউটার বিজ্ঞানসহ প্রকৌশলের মতো একাধিক শাখায় ব্যবহৃত হয়। বেশির ভাগ সময় ফরেনসিক বিজ্ঞান দেওয়ানি মামলার তুলনায় ফৌজদারি মামলা তদন্ত ও সমাধানের জন্য অধিক ব্যবহৃত হয়।
১৮৯২ সালে বিশ্বে প্রথম ফিঙ্গার প্রিন্ট ডাটাবেস প্রয়োগ করে একটি হত্যা মামলায় রক্তাক্ত আঙুলের ছাপ দ্বারা আর্জেন্টিনায় অপরাধীকে ধরতে সাহায্য করেছিল। এ ছাড়া ব্রিটিশ ও চাইনিজরা ফৌজদারি মামলায় ফরেনসিকের ব্যাপক ব্যবহার করে। সাধারণত যে কোনো হত্যা একটি গোপন, অস্পষ্ট, জটিল ও রহস্যজনক উপায়ে সংঘটিত হয়, শুধু কৌশলগত অনুসন্ধান কিংবা প্রত্যক্ষ সাক্ষীর সাক্ষ্য বা স্বীকারোক্তি ব্যবহার করে অনেক সময় আসামি শনাক্ত করা দুরূহ। কারণ অনেক সময় সাক্ষীরা বিভিন্ন কারণে সাক্ষ্য দিতে অনীহা দেখান। তদুপরি কথিত আছে, অনেক সময় সাক্ষীও পক্ষপাতিত্বমূলক সাক্ষ্য দেন। তাই মৌখিক সাক্ষীর তুলনায় ফরেনসিক সাক্ষ্য অধুনা বিভিন্ন দেশে অধিক গ্রহণযোগ্য হচ্ছে।
কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর অপরাধ স্থানে অপরাধী বিভিন্ন ধরনের আলামত (Physical evidence/ evidence) অজ্ঞাতসারেই রেখে যায়। এ কারণে ফরেনসিক বিজ্ঞানের পথ প্রদর্শক স্যার ড. এডমন্ড লকার্ড বলেছেন, ‘Every contact leaves a trace’. বিভিন্ন ধরনের অপরাধে বিভিন্ন ধরনের আলামত পাওয়া যেতে পারে, যেমন—রক্ত, বীর্য, প্রস্রাব, যোনি নিঃসৃত সোয়াব, লালা, বমি, চুল, ফাইবার, আঙুলের ছাপ, পায়ের ছাপ, দাঁতের চিহ্নআ ছাপ, ওষুধ, আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ, কাচ, চুল, ভিসেরা, পেট্রোলিয়াম পণ্য দাগ, পাউডারজাতীয় পদার্থের অবশিষ্টাংশ, মাটি, টুলমার্ক, তার, সিরিয়াল নম্বর, কাঠ, পরাগ, অন্যান্য উদ্ভিজ্জ পদার্থ, যা অপরাধের দৃশ্যের সঙ্গে একজন ব্যক্তি, ব্যক্তিবর্গ বা বস্তুর সঙ্গে সংযোগ করতে পারে। এছাড়া এই আলামত প্রমাণ হিসেবে বিচারব্যবস্থায় কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়। তিনটি উৎস থেকে আলামত পাওয়া যেতে পারে : ১. ভিকটিমের ক্রাইমসিন থেকে, ২. সন্দেহভাজন ব্যক্তির কাছ থেকে এবং ৩. তার পরিবেশ থেকে। বাংলাদেশে ক্রাইমসিনে প্রধানত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ফরেনসিক টিমের দক্ষ সদস্যরাই আলামত সংগ্রহ করেন, প্রয়োজনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। অনেক দেশে আইনি অনুসন্ধান প্রতিবেদন (Inquest Report)-এ তদন্তকারী অফিসার ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদেরও স্বাক্ষর থাকে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা প্রাপ্ত আলামত বিশ্লেষণ দ্বারা অপরাধী, ভিকটিম ও নিখোঁজ ব্যক্তিকে সহজেই শনাক্ত করেন। যখনই কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় এবং প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায় না, তখন ক্রাইমসিন থেকে পাওয়া অপরাধীর আঙুলের ছাপ, পায়ের ছাপ, হাতের তালু, টুলমার্ক, ট্রেসমার্ক ফরেনসিক বিজ্ঞানের সাহায্যে বিশ্লেষণের মাধ্যমে অপরাধীকে শনাক্ত করা সহজ করে তোলে। ফরেনসিক বিজ্ঞান বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি মামলা যেমন ধর্ষণ, দুর্ঘটনা সম্পর্কিত সমস্ত ঘটনা, নিখোঁজ ব্যক্তি অপহরণ, হত্যা, প্রতারণা, আত্মহত্যা, জালিয়াতি ইত্যাদি সমাধানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
বর্তমানে ফরেনসিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্র বিস্তৃত, যেখানে নানা ডিসিপ্লিনের বিশেষজ্ঞ থাকে, যেমন—ডিএনএ বিশ্লেষণ, ড্রাগ কেমিস্ট্রি, পেইন্ট এবং গ্লাস অ্যানালাইসিস, টক্সিকোলজি, আঙুলের ছাপ বিশ্লেষণ, রক্তের দাগের প্যাটার্ন বিশ্লেষণ, আগ্নেয়াস্ত্র পরীক্ষা এবং ব্যালিস্টিকস, টুলমার্ক বিশ্লেষণ, সেরোলজি চুল ও ফাইবার বিশ্লেষণ, প্রশ্নযুক্ত নথি, নৃতত্ত্ব, ওডেনটোলজি, এপিডেমিওলজি, ফুটওয়ার এবং টায়ারমার্ক বিশ্লেষণ, ডিজিটাল অডিও-ভিডিও, ফটো অ্যানালাইসিস ইত্যাদি। ফরেনসিক বিজ্ঞান যত উত্কর্ষতা লাভ করবে, ভুক্তভোগীরা তত বেশি ন্যায়বিচার পাবে, সঙ্গে সঙ্গে আমরাও একটা শান্তিপূর্ণ সমাজে বসবাস প্রত্যাশা করতে পারব। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেড ক্রস (ICRC) মানবিক উদ্দেশ্যে ফরেনসিক বিজ্ঞান ব্যবহার করে সশস্ত্র সংঘাত, বড় ধরনের প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম বিপর্যয় বা অভিবাসনের পরে নিখোঁজ ব্যক্তিদের শনাক্ত কিংবা অবস্থান স্পষ্ট করতে ব্যবহার করছে। উদাহরণস্বরূপ, ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন মিসিং পার্সন (ICMP) নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার জন্য ফরেনসিক বিজ্ঞান ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে। এছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তের জন্য ফরেনসিক তদন্তের গুরুত্বকে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দিয়েছে। এক্ষেত্রে ‘মিনেসোটা প্রোটোকল’ নামে একটি ম্যানুয়াল তৈরির মাধ্যমে মানবিক বিষয়ে ফরেনসিকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকার করেছে। বাংলাদেশে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় ফরেনসিক আলামতের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনি কাঠামো হলো—ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮; সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২; আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩; মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮; ডি-অক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) আইন, ২০১৪; ভোক্তা সুরক্ষা আইন, ২০০৯; খাদ্য নিরাপত্তা আইন, ২০১৩; বেঙ্গল পুলিশ রেজল্যুশন, ১৯৪৩; এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০২, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২; ক্রেতা সংরক্ষণ আইন, ২০০৯। অনেকের মতে, ফরেনসিক আলামত পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা বাধ্যতামূলক করে কিছু ক্ষেত্রে আইন সংশোধন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইনের ধারা ৪৫-এর অধীনে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের মতামত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে বলেও অনেকে মত দেন।
আমাদের দেশে উৎসুক জনতার কারণে অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবেও আলামত ধ্বংস হয়। এছাড়া কিছু সাংবাদিকেরও অনিচ্ছাকৃতভাবে সংবাদ সংগ্রহসহ লাইভ সম্প্রচারের তীব্র প্রতিযোগিতায় অনেক ক্ষেত্রে আলামত দূষিত, এমনকি আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হতে পারে। উপরন্তু, আলামত সংগ্রহের সঠিক প্রটোকল না মানা এবং সংগৃহীত আলামতের সঠিকভাবে সংরক্ষণ কিংবা প্রটোকল না মেনে সংরক্ষণের কারণেও আলামত আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হতে পারে। এছাড়া আলামতে পরীক্ষণের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের ও পেশাদারিত্বের অভাবও এক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের ক্ষেত্রে অন্তরায় হতে পারে। যেসব কারণে আলামত কাঙ্ক্ষিত ফলাফল কখনো কখনো পাওয়া সম্ভব হয় না তাহলো :১. অপরাধের দৃশ্য সুরক্ষিত করতে বা ‘চেইন-অব কাস্টডি’ বজায় রাখতে ব্যর্থ হওয়া; ২. সঠিকভাবে প্রটোকল মেনে আলামত সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হওয়া; ৩. মিরান্ডা সতর্কতা না মানা, উপরন্তু অন্যান্য সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করা; ৪. অনুমোদিত ব্যক্তির সংখ্যা সীমাবদ্ধতায় রাখতে না পারা; ৫. আলামতে যথাযথ ‘চেইন অব সেফটি’ বজায় না রাখা; ৬. দূষণ কমানোর জন্য সুরক্ষা ব্যবহার না করা; ৭. আলামতের সংগ্রহের সঠিক ডকুমেন্টেশন না রাখা বা না জানা।
আধুনিক যুগে অপরাধের হার বাড়ার সঙ্গে কৌশলও বদলেছে এবং অপরাধে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। তাই এটি প্রাসঙ্গিক যে ক্রমবর্ধমান এ ধরনের অপরাধের মোকাবিলার জন্য ফরেনসিকে সব ডিসিপ্লিনে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ যেমন প্রয়োজন, সেই সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি এবং এর সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এছাড়া বিচারের সঙ্গে যুক্ত স্টেকহোল্ডারদেরও ফরেনসিক আলামতের বিষয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। ক্রমবর্ধমান অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রেখে অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে অপরাধমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আশার কথা হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবারের পুলিশ সপ্তাহে ফরেনসিকের উন্নয়নে এবং এর উৎকর্ষতার জন্য তার সরকারের দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা উল্লেখ করেছেন।
ফরেনসিক বিজ্ঞান অপরাধ তদন্তে এবং বিচারব্যবস্থার মেরুদণ্ড ফৌজদারি এবং আইনি ব্যবস্থায় ফরেনসিক বিজ্ঞানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলছে, যা ছাড়া প্রকৃতপক্ষে অপরাধবিজ্ঞানের ধাঁধাঁ অসম্পূর্ণ। ক্রাইমসিন বা অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে অক্ষত আলামত সংগৃহীত না হলে কিংবা সংগৃহীত হলেও দূষণ বা অন্যান্য কারণে আলামত আংশিক বা পূর্ণভাবে ধ্বংস করা অথবা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না হলে অপরাধের প্রকৃত দৃশ্য প্রস্ফুটন কঠিন—পরিণতি হলো, অপরাধীরা শাস্তির হাত থেকে যেমন রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা, তেমনি সন্দেহ থেকে নির্দোষ ব্যক্তিতে মুক্ত করাও কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অপরাধদৃশ্য (ক্রাইমসিন) থেকে পাওয়া অক্ষত আলামতই পারে অপরাধের প্রকৃত স্টোরি রচনা এবয় ফরেনসিক বিজ্ঞানকে নির্ভরযোগ্য করতে। অনেকে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ফরেনসিক বিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়া পৃথিবীতে খুনি, চোর, মাদক পাচারকারী এবং ধর্ষকেরা মুক্তভাবে বিচরণ করবে। ফরেনসিকের বিবর্তন বিজ্ঞান মৌখিক সাক্ষ্যের সীমা অতিক্রম করবে এবং একুশ শতকের বিচারব্যবস্থায় যথাযথ সহায়তা প্রদান করবে—এটাই সবার প্রত্যাশা।