সম্প্রতি লাতিন আমেরিকা সফর করেছেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন। সফরকালে মার্কিন হাউজ স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থির সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন সাই। ম্যাকার্থি সাইকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, চীনের ক্রমাগত হুমকির প্রশ্নে আমেরিকার সমর্থন পাবে স্বাধীন দ্বীপ তাইওয়ান। সাইয়ের যুক্তরাষ্ট্র সফর ও তাইওয়ানের প্রতি আমেরিকার অব্যাহত সমর্থনকে স্বভাবতই ভালোভাবে নেয়নি চীন। শোনা যাচ্ছে, তাইওয়ানকে ঘিরে ফেলতে সামরিক মহড়া শুরু করেছে শির বাহিনী!
আরেকটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। দিন পাঁচেক আগে বেইজিং সফর করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ম্যাক্রোঁর সঙ্গে বিশাল প্রতিনিধিদলের পাশাপাশি ছিলেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লেইনও। সফরকারীরা ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে রাশিয়াকে অনুরোধ করার আহ্বান জানান চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়রে কাছে। পাশাপাশি ইউরোপ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য জোরদার করার কথাও বলা হয়।
মনে রাখা দরকার, সাই ও ম্যাক্রোঁ উভয়ের সফরকেই রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। এর কারণ, সাই যখন আমেরিকা সফর করেন, একই সময়ে বেইজিংয়ে ছুটে যেতে দেখা গেছে তাইওয়ানের প্রথম ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মা ইং-জিউকে, যিনি ও যার দল কেএমটিকে কিনা আখ্যায়িত করা হয় চীনের ‘বন্ধুপ্রতিম’ হিসেবে! যা হোক, সাই ও মার সফরের রেশ কাটতে না কাটতেই বেইজিংয়ের মাটিতে পা পড়ল ম্যাক্রোঁ, উরসুলাসহ বিশাল ইউরোপীয় দলের। এই সফরের উদ্দেশ্য হিসেবে চীন-ইউরোপ বাণিজ্য সম্পর্ক মজবুত করার কথা বলা হচ্ছে বটে, কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—আসল ঘটনা কি তাই?
বাস্তবতা হলো, ইউক্রেন-সংকট নিয়ে ইউরোপ যে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে, তাইওয়ানের সম্ভাব্য সংকটের প্রশ্নে দেখা যাচ্ছে তার বিপরীত চিত্র! তাইওয়ান ইস্যুতে চীনের বিষয়ে ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের ‘সংশয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি’ ক্রমবর্ধমানভাবে দৃশ্যমান! মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি জে ব্লিনকেনের সাম্প্রতিক কথাবার্তায় এই দাবির প্রমাণ পাওয়া যায়।
লক্ষণীয় বিষয়, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার সঙ্গে সঙ্গে চীনের বিপক্ষেও কথা বলে আসছে। সম্মিলিতভাবে নিন্দা জানিয়ে আসছে। বিশেষ করে, গত মাসে মস্কোয় শির সঙ্গে পুতিনের দেখা করার নিন্দায় সবাইকে এককাট্টা হতে দেখা যায়। কিন্তু তাইওয়ান প্রশ্নে কি একই ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়?
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টায় ৫০ জন ফরাসি ব্যাবসায়িক নির্বাহীকে নিয়ে বেইজিং সফর করলেন—এ বিষয়ে কি তেমন প্রতিক্রিয়া এসেছে? এর আগে গত নভেম্বরে বেইজিং সফরে গিয়েছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ। তখনো তার সঙ্গে ছিল বিরাট বহর। করপোরেট এক্সিকিউটিভদের বিশাল প্রতিনিধিদল নিয়ে চীনে গিয়েছিলেন তিনি। সেই ঘটনা নিয়েও কি খুব একটা প্রতিক্রিয়া ছিল? সফরের পর চীন-জার্মানি যে যৌথ বিবৃতি দেয়, তা ছিল চোখে পড়ার মতো! ইউক্রেনে পারমাণবিক হামলার হুমকির জন্য পুতিনের সমালোচনা করতে দেখা যায় বটে, কিন্তু রাশিয়াকে ‘আক্রমণকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করার বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়!
এ ঘটনার পর ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের এশিয়া প্রোগ্রামের ডিরেক্টর জাংকা ওরটেল টুইটারে লিখেছিলেন, ‘এর ফলে চীনের এমন ধারণা হতে পারে যে, রাশিয়াকে সমর্থন করলেও ইউরোপের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।’
ম্যাক্রোঁর বেইজিং সফরের পর জাংকা লিখেছেন, ‘ইউরোপীয় নেতারা যদি কোনো ব্যাবসায়িক প্রতিনিধি দল ছাড়া বেইজিংয়ে যেতেন, তবে তা ভালো হতো। এর ফলে বেইজিংয়ের কাছে স্পষ্ট বার্তা যেত—অযাচিত সংঘাত সৃষ্টিকারী পুতিনকে সমর্থন করলে চীনের সঙ্গে ইউরোপের কোনো ধরনের লেনদেন থাকবে না।’
ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের সবচেয়ে বড় ‘ফ্ল্যাশপয়েন্ট’ হলো তাইওয়ান। মার্কিন কর্মকর্তারা তো বটেই, বিশ্বের অধিকাংশ বিশ্লেষক মনে করেন, স্বাধীন দ্বীপ তাইওয়ানের ওপর চীন যদি কোনোভাবে সামরিক আগ্রাসন চালায়, তবে তা বহুমাত্রিক সংঘাতের জন্ম দেবে। এর ফলে দেখা দেবে ইউক্রেনের চেয়েও বড় ধরনের ‘সংকট’।
আশঙ্কা করা হয়, তাইওয়ান আক্রমণের পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ, যা ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়েও বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। মূলত এই আশঙ্কা থেকেই বিশ্বশান্তির স্বার্থে তাইওয়ানের প্রতি অব্যাহত সমর্থন জানিয়ে আসছে ওয়াশিংটন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ‘তাইওয়ান ইস্যু’ আলোচনার টেবিলে উঠলেই তা নিয়ে একপ্রকার শোরগোল পড়ে যায়—কী যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের পক্ষ থেকে, কী চীনের আইনপ্রণেতাদের তরফ থেকে। তাইওয়ানে আক্রমণ চালালে চীনা সামরিক বাহিনীকে ঠেকাতে আমেরিকা কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, কতটা সাহায্য পাবে তাইওয়ানিজরা—এসব নিয়ে বিরামহীন বিতর্ক চলে। উদাহরণস্বরূপ :তাইওয়ান ইস্যু নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অন্তত চার বার ‘উচ্চ স্বরে’ কথা বলেছেন। বাইডেনকে বলতে শোনা গেছে, ‘চীন আক্রমণ করলে মার্কিন সামরিক বাহিনী তাইওয়ানকে রক্ষা করবে।’ বাইডেনের এ ধরনের কথার বিপরীতে চীনও বেশ উত্তপ্ত বাক্য উচ্চারণ করে। চীনের পক্ষ থেকে বহুবার বলা হয়েছে, ‘তাইওয়ান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র বেশি বাড়াবাড়ি করলে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে!
আমরা দেখেছি, তাইওয়ান ইস্যু নিয়ে উভয় পক্ষের আইনপ্রণেতারাও প্রায়শই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় ম্যাকার্থির সঙ্গে সাইয়ের সাক্ষাত্ কিংবা গত বছরের আগস্টে সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর ঘিরে আইনপ্রণেতাদের পালটাপালটি বক্তব্য-মন্তব্যের দিকে দৃষ্টি দিলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে।
এখন প্রশ্ন হলো, তাইওয়ান ইস্যুর কি কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে না? স্বাধীন এই দ্বীপ নিয়ে চীনের প্রকৃত উদ্দেশ্যই বা কী? তাইওয়ানকে রক্ষার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বাস্তবসম্মত’ চিন্তা, পদক্ষেপই আসলে কী? এসব প্রশ্নের উত্তরে আমরা বিবেচনায় নিতে পারি মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলির কথার দিকে। সম্প্রতি নিউজ সাইট ডিফেন্স ওয়ানকে তিনি বলেছেন, ‘তাইওয়ান নিয়ে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের আশঙ্কা কতটা—এটা মুখ্য বিষয় নয়, বরং এক্ষেত্রে মুশকিল হলো অবান্তর ও অযৌক্তিক কথাবার্তা। বিভিন্ন পক্ষ থেকে অহেতুক, উসকানিমূলক বিবৃতিই পরিবেশকে অতিরিক্ত উত্তপ্ত করে তুলছে।
যা হোক, ফিরে আসি ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের বেইজিং সফরের দিকে। বলে রাখা জরুরি, ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ অনেকটা বিরল। যদিও চীনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কথা শোনা যায় সময়ে সময়ে। ইউরোপকে চীনের সঙ্গে মেলামেশার প্রশ্নে মার্কিন কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বাধ্যবাধকতা বা শর্ত নেই বলেও বলা হয়।
আরেকটি দিকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি, মার্কিন প্রশাসন বেশ কিছু ইউরোপীয় মিত্রকে তাইওয়ানের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়ে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছে। অনেক মিত্র তাইওয়ানে চীনের সামরিক পদক্ষেপের ঘোর বিরোধী। আমরা দেখেছি, গত মাসে জার্মানির শিক্ষামন্ত্রী বেটিনা স্টার্ক-ওয়াজিংগার তাইওয়ান সফর করেন। বিগত ২৬ বছরের মধ্যে তিনিই প্রথম তাইওয়ান সফরকারী জার্মান মন্ত্রিপরিষদ কর্মকর্তা। তাইওয়ান প্রশ্নে আমেরকার বাতলে দেওয়া পথে হেঁটে আসছে ব্রিটেন, ফ্রান্সও। উভয় দেশই মার্কিন নৌবাহিনীর নিয়মিত মহড়ায় অংশ নিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাইওয়ান প্রণালিকে এসব দেশের যুদ্ধজাহাজ পাহারা দিতেও দেখা যায়। বিশেষ করে, সাতটি দেশ তাইওয়ানের পক্ষে বরাবরই সরব। এসব দেশ ২০২১ সাল থেকে ‘তাইওয়ান প্রণালি জুড়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা’ বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে নিয়মিত বিবৃতি দিয়ে আসছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও বিশাল দলবলসহ ফরাসি প্রেসিডেন্টের চীনে উড়ে যাওয়া কী বার্তা দেয়? এ প্রসঙ্গে ওবামা প্রশাসনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সিনিয়র এশিয়া ডিরেক্টর জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইভান মেডিইরোসের একটি মন্তব্যের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। অধ্যাপক ইভানের মতে, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপীয় দেশগুলোর তাইওয়ানের প্রতি মনোভাব দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত। এসব দেশ তাইওয়ানকে সত্যিকার অর্থে কী ধরনের সমর্থন করে, তা ভেবে আমি বেশ অবাক হয়েছি।
আসল কথা বলেছেন ট্রাম্প প্রশাসনের পেন্টাগনের সিনিয়র কর্মকর্তা এলব্রিজ কোলবি। এই কর্মকর্তা বলেছেন, ‘বেইজিংয়ে ইউরোপীয় নেতারা কি শুধুই বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে গেছেন, নাকি এর পেছনে অন্য কিছু আছে?’ কোলবি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘ইউরোপীয়দের তত্পরতা দেখে এটা বেশ ভালোভাবে বোঝা যায়, চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের পক্ষে নয় তারা।’ কোলবির পরের কথাটি অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘মার্কিন প্রশাসন মনে করে, তাইওয়ান নিয়ে কোনো ধরনের সংঘাতের সৃষ্টি হলে ইউরোপীয়রা আমেরিকার সঙ্গে থাকবে, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটবে বলে আমার মনে হয় না।
সত্যিই যদি এমনটা ঘটে, তবে সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কী করা উচিত, তার উত্তরও বলে দিয়েছেন কোলবি। তিনি বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে, তাইওয়ানে চীনের সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে এই অঞ্চলে মিত্রদের, বিশেষ করে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নিজস্ব সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করা। সেই লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাজ হবে ইউক্রেন যুদ্ধে মনোনিবেশের পাশাপাশি তাইওয়ানের প্রতিও অধিক নজর দেওয়া।