মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। ঠিক যেন পদ্মপাতার জলের মতো। তবুও মানুষ ক্ষুদ্র এই জীবনকে বড্ড বেশি ভালোবাসে। সুন্দর এই ভুবনের মায়ায় বিভোর হয়ে ক্ষণস্থায়ী জীবনকে ঘিরে নানা আয়োজনের পসরা বসায়। জীবনকে সাজাতে, রঙিন আলোয় রাঙাতে মানুষের প্রচেষ্টার কোনো কমতি থাকে না। ছোট্ট এই জীবনের প্রতি মানুষের কতই-না ভালোবাসা, কত স্বপ্ন আর আশার আলোকছটা। জীবনে একটুখানি সুখ আর সমৃদ্ধি আনতেই মানুষের এই নিরন্তর ছুটে চলা। বহু আকাঙ্ক্ষিত আর ভালোবাসার এই সুন্দর জীবনকে রাঙাতে ব্যস্ত মানুষও কখনো কখনো নিজেকে নিঃশেষ করে দেয় এক নিমেষেই। বেছে নেয় আত্মহননের পথ। কিন্তু কেন জীবনের প্রতি এই বিমুখতা আসে? কেনই-বা সুন্দর এই পৃথিবীর সব মায়া-মমতা-আশা-ভরসা এবং ভালোবাসাকে ত্যাগ করে অনন্ত মহাকালের অতল সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার বাসনা জাগে। কেনই-বা মানুষ মহিমান্বিত এই জীবনের সব সাধ-আহ্লাদকে ছিন্ন করে আত্মহত্যার পথকে বেছে নেয়? এই নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিদ এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকলেও ঠিক কোন কারণে, কোন চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে মানুষটি আত্মহত্যা করে তা আমরা কেউ জানি না। কারো পক্ষে জানা সম্ভবও নয়। ঠিক কী যুক্তি ঐ সময়ে কোন অচীন পাখির ঝাপটানো হাওয়া তাকে ঠেলে দেয় অন্তিম লোকের পথে, তা জানা দুঃসাধ্য।
বর্তমান বিশ্বে আত্মহত্যার কারণে মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে দিনদিন বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর বিশ্বে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে একটি। বিশেষত ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সি যুবক-যুবতিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সর্বাধিক। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলছে। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। যেখানে সংস্থাটির ২০২১ সালের সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১০১টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। মূলত কোন দেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি সেই সমাজের মানুষের আচার-আচরণ, চিন্তা-চেতনা, আদর্শ ও মূল্যবোধকে ত্বরান্বিত করে। সমাজকাঠামো সৃষ্ট বাস্তবতা ব্যক্তির মনোজগৎ এবং তার কার্যাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজের বাস্তবতা যখন ব্যক্তির মূল্যবোধ ও আকাঙ্ক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে তখন ব্যক্তি তার নিজের ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়। যে কারণে সমাজের যৌথ মূল্যবোধের সঙ্গে ব্যক্তি মূল্যবোধের দ্বন্দ্বের দরুন ব্যক্তি পরিবার, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আর এই বিচ্ছিন্নতাই তাকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ব্যক্তি হয়তো নিজের পছন্দমতো কিংবা সমাজ কর্তৃক মূল্যারোপকৃত একটি পেশাকে বেছে নিতে চায়, কিন্তু সামাজিক বাস্তবতা এবং ব্যক্তির সক্ষমতাসহ প্রভৃতি কারণে ব্যক্তি অনেক সময় সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না। আর এর সঙ্গে পারিবারিক প্রত্যাশা এবং সামাজিক চাপ যুক্ত হওয়ায় ব্যক্তির নিজের ইচ্ছা এবং সামর্থ্যের দ্বন্দ্ব তাকে অনেক সময় আত্মহত্যার দিকে চালিত করে থাকে। অন্যদিকে, প্রসিদ্ধ সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম তার বিখ্যাত ‘সুইসাইড’ গ্রন্থে আত্মহত্যাকে একটি সামাজিক কারণ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। ডুর্খেইম মূলত সমাজের সংহতি এবং নিয়ন্ত্রণের মাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে আত্মহত্যাকে বিশ্লেষণ করেছেন।
তিনি বলেছেন, একটা সময় মানুষ নিজের জীবনকে অর্থহীন মনে করে পরিবার-সমাজ-সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করে সম্পূর্ণ আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপন করতে থাকে। সে সময় ব্যক্তির ওপর সমাজের সংহতি ও নিয়ন্ত্রণের মাত্রার শিথিলতার দরুন মানুষ আত্মহত্যার দিকে পা বাড়ায়। বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণকে ডুর্খেইমের এই আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যার পর্যায়ভুক্ত করা যায়। জানা যায়, আত্মহননকারী শিক্ষার্থীরা অধিকাংশই অবিবাহিত এবং তারা নিজেদেরকে সব সময় পারিপার্শ্বিক বন্ধুবান্ধব তথা সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখত। যে কারণে সমাজ ও পরিবারের প্রতি তার দায়িত্ব এবং নিয়ন্ত্রণের মাত্রা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে এবং ব্যক্তিজীবনের কোনো অর্থ খুঁজে না পেয়ে পরিশেষে আত্মহননের পথে চালিত হয়। হতাশা, বিষণ্ণতা আর একাকীত্বের ডালপালায় আচ্ছন্ন আত্মহননের মতো ভয়ংকর ব্যাধি সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মকে গ্রাস করে চলেছে প্রতিনিয়ত। আত্মঘাতী এই প্রবণতা প্রতিরোধে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমবয়সী সঙ্গী তথা সামাজিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টি অত্যন্ত জরুরি। এজন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্যের কাউন্সিলিং কেন্দ্রের সুবিধা নিশ্চিত করা অতীব প্রয়োজনীয়। সেই সঙ্গে পারিবারিক সহমর্মিতা, সহযোগিতার মাধ্যমে সন্তানের সুসময়ে ও দুঃসময়ে পাশে থাকতে হবে। হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিকে জীবনের বাঁকে বাঁকে থাকা নানা চ্যালেঞ্জের কথাও অবগত করা যেতে পারে। নিজেদের উপলব্ধি করতে হবে প্রতিকূলতার মধ্যে এগিয়ে চলার নামই জীবন। সর্বোপরি পারিবারিক বন্ধনকে আরো মজবুত করতে হবে। নিজের সমস্যার কথা শেয়ার করতে মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পেন্ডোরার বক্সের দুঃখ, জরা, শোক ও হতাশার মধ্যেও বিরাজমান থাকা আশা নামক বস্তুর কথা। যার ভেলায় চড়ার স্বপ্নকে লালন করে মানুষ তার জীবনকে উপভোগ করতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, নিরাশার দোলাচলে থাকা জীবনেও আশার ঝিলিকই আমাদের প্রেরণা জোগায়, অনুপ্রেরণা হয়ে থাকে বেঁচে থাকার।