কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা অপরিহার্য। এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, কার্যকর ও দক্ষ বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা ছাড়া কৃষিকে লাভজনক বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করা বেশ কঠিন। লাভজনক কৃষি খাত নিশ্চিতকরণে কৃষকের দরকষাকষির সামর্থ্য বড়ানোসহ কৃষকদের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার সুযোগ তৈরি করতে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কথা সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে জাতীয় কৃষি নীতিমালা, ২০১৮তে। উক্ত নীতিমালা বা পদক্ষেপসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে কৃষিপণ্যের সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠবে এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে উক্ত নীতিমালায় যেসব বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কৃষিপণ্যে মূল্য সংযোজন ও ভ্যালু চেইনের উন্নয়ন ঘটা।
ভ্যালু চেইন উন্নয়ন ধারণাটি এসেছে আধুনিক বিপণন ব্যবস্থাপনা থেকে। ১৯৮৫ সালে মাইকেল পর্টার কৃষি ব্যবসার প্রসার ঘটাতে তিনিই সর্বপ্রথম এই ধারণার প্রবর্তন করেন এবং সফলভাবে এর প্রয়োগ ঘটান। মূলত ভ্যালু চেইন হলো কৃষি বিপণনের অনেকগুলো কাজের সমন্বিত ধারাবাহিক প্রক্রিয়া বা প্রচেষ্টা বা ধাপ, যেখানে পণ্য উৎপাদন থেকে ভোক্তাদের খাবার টেবিল পর্যন্ত কাজগুলো ধারাবাহিকভাবে চলমান থাকে। ধারাবাহিকভাবে প্রতিটি ধাপে পণ্যমূল্য সংযোজন হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, পণ্য বাছাইকরণ, শ্রেণিকরণ, প্যাকেজিং, লেবেলিং ও ব্রান্ডিং—এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে পণ্যে মূল্য সংযোজন হয়, অর্থাৎ ভ্যালু এডিশন হয়। ভ্যালু চেইনে পণ্যের মান বজায় থাকে, দাম সুনির্দিষ্ট থাকে বিধায় বিশ্বস্ততা বাড়ে। সবচেয়ে বড় কথা, ভ্যালু চেইন উন্নয়নে ভ্যালু চেইন অ্যাক্টরস, যেমন—কৃষক, ফড়িয়া, ব্যাপারী, পাইকার, আড়তদার, প্রক্রিয়াজাতকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে উইন-উইন সিচুয়েশন কাজ করে।
টেকসই ভ্যালু চেইন উন্নয়নে সহযোগী অনেকগুলো কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি। বাজারের অবকাঠামো উন্নয়ন ও বাজার অ্যাক্টরদের দক্ষতা বৃদ্ধি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে টেকসই ও কার্যকর সরবরাহ চেইন তৈরি করা যায়। ডিজিটাল প্রযুক্তিসমূহ তথা ই-মার্কেটিংয়ের বিভিন্ন অনলাইন অ্যাপস ব্যবহার সরবরাহ চেইনকে আরো স্মার্ট করে তুলবে। সরবরাহব্যবস্থা দ্রুত করবে। তাতে সময় ও খরচ দুই-ই বাঁচবে। টেকসই ও কার্যকর সরবরাহ চেইন ভ্যালু চেইনের প্রধান হাতিয়ার। বাজারের নতুন অবকাঠামো উন্নয়নে জায়গা নির্বাচন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাজার জোর করে সৃষ্টি করা যায় না। এটি চাহিদার ভিত্তিতে প্রয়োজনের তাগিদে আপনা-আপনি গড়ে ওঠে। নতুন বাজার গড়ে তোলা কঠিন হলে বা জায়গার সংস্থান না হলে বিকল্প হিসেবে যেখানে ইতিমধ্যে বাজার গড়ে উঠেছে, সেখানে অবকাঠামো স্থাপন করে দিতে পারে অথবা বিদ্যমান বাজারের অবকাঠামোকে আধুনিকায়ন করা যেতে পারে।
আধুনিকায়ন বলতে বাজারের স্যানিটেশন-ব্যবস্থা উন্নত করা, পণ্য ধৌতকরণের সুযোগ রাখা, মিনি সংরক্ষণাগার বা কোল্ড চ্যাম্বার স্থাপন করা, বেশি পণ্য একসঙ্গে ওজন করার সুযোগ রাখা। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের কেরালা রাজ্যে কেরালা পাইনঅ্যাপল সিটিতে ২০ টনের এক ট্রাক আনারস একটি ব্রিজ টাইপের কম্পিউটারাইজড ওয়ে মেশিনে ট্রাকসহ একসঙ্গে দুই মিনিটে ওজন নিতে দেখেছি। ওজন নেওয়ার বিনিময়ে চার্টে দৃশ্যমান একটি নির্দিষ্ট ফি প্রদান করতে হয়। ওয়ে মেশিনে বিপুল পরিমাণ আনারস খুব সহজে অল্প টাকার বিনিময়ে খুব অল্প সময়ে ওজন নেওয়ার কাজটি সেরে ফেলা যায়। এটি স্মার্ট বিপণনের একটি অংশই বলা যায়। আমাদের দেশেও এসব সুবিধা বাড়ানো যায় কি না, ভাবা যেতে পারে। হাটবাজার উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে উত্সাহিত করা গেলে এটি সহজে সম্ভব। তাদের সহায়তায় আধুনিক মানের সংরক্ষণাগার ও প্যাকেজিং হাউজ (প্যাক-হাউজ) স্থাপন করা গেলে কৃষিপণ্যের অপচয় কমবে। কৃষিপণ্যের হাট ও বাজারসমূহে ডিজিটালকরণকে আরো উত্সাহিত করা দরকার।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিপণ্যের অপচয় রোধ করার মাধ্যমে কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজন কার্যক্রম যেমন— প্যাকেজিং, লেবেলিং ও ব্র্যান্ডিং তথা জিআই প্রডাক্ট হিসেবে চিহ্নিতকরণ ইত্যাদি কার্যক্রমের জনপ্রিয়করণে সম্প্রসারণ সেবা বাড়ানো ও এর সুফল সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার চালানো গেলে সবাই উদ্বুদ্ধ হবে। বিপণনের পূর্বশর্ত মানসম্মত কৃষিপণ্য উৎপাদন। এটি নিশ্চিত করার জন্য উত্তম কৃষিচর্চার বাস্তব প্রয়োগ ঘটার বিকল্প নেই। রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনে এটি বেশ কার্যকর। রপ্তানিযোগ্য পণ্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে রপ্তানি বাজার অনুসন্ধান ও সম্প্রসারণ করা গেলে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের সুযোগ বাড়বে। এটি করতে কৃষক সংগঠন তৈরি করা বা বিদ্যমান সংগঠনগুলোকে অধিক শক্তিশালী করা দরকার। সংগঠনের মধ্য থেকে চার-পাঁচ জন সদস্যকে নিয়ে বিপণন দল গঠন করে দলগত বিপণনের সুযোগ তৈরি করা যায়।
স্মার্ট বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে দলগত বিপণনকে উত্সাহিত করতে সরকারের কৃষি বিপণন নীতিমালা, ২০২০-এ সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। এসব নীতিমালার বাস্তবে প্রয়োগ ঘটানো খুব জরুরি। এ বিষয়ে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কৃষিপণ্যের স্মার্ট বাজারব্যবস্থা গড়ে তুলতে কৃষক সংগঠনগুলোকে স্মার্ট করে গড়ে তোলা জরুরি। তার জন্য সংগঠনগুলোর স্মার্ট নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানো দরকার। সংগঠনের নেতৃত্বের উন্নয়ন ঘটাতে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে এসে দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণ প্রদান জরুরি। কারিগরি দক্ষতার পাশাপাশি যোগাযোগ দক্ষতা, নেতৃত্বের উন্নয়ন দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি, জটিল সমস্যা সমাধান বিষয়ে দক্ষতার উন্নয়ন, কোলাবরেশন দক্ষতা এবং নেগোশিয়েশন দক্ষতা—এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে কৃষক সংগঠনগুলো স্মার্ট হয়ে উঠবে। প্রক্রিয়াজাতকারী ও উদ্যোক্তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণের বেশি প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া অপেক্ষাকৃত সৎ ও স্মার্ট লোকদের নিয়ে চৌকশ নেতৃত্বে একটি স্মার্ট বাজার কমিটি করা গেলে বাজার পরিচালনায় সুফল মিলবে, গড়ে উঠবে কৃষিপণ্যের একটি স্মার্ট বাজার ব্যবস্থাপনা।