পরিণত বয়সেই বিদায় নিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধ, চিকিৎসা ও সমাজসেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন এক কথায় অসাধারণ। জাফরুল্লাহ চৌধুরী নাগরিক অধিকার আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। অসুস্থ শরীরেও তিনি মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে নিয়মিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন ভাস্কুলার সার্জন। তিনি মূলত জনস্বাস্থ্য চিন্তাবিদ। ১৯৮২ সালের ঔষধনীতি দেশকে ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে, ঐ নীতি প্রণয়নের অন্যতম কারিগর ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বহির্বিশ্বে তার পরিচয় বিকল্পধারার স্বাস্থ্য আন্দোলনের সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে।
তার রাজনৈতিক মত ও বিশ্বাস ছিল। তিনি যেমন নিজের চিন্তাভাবনার কথা অকপটে তুলে ধরতেন, তেমনি অন্যের কথাও মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তার কথাই সবাইকে শুনতে বা মানতে হবে, এমন সংকীর্ণতা তার ছিল না। ভিন্ন মতের মানুষের সঙ্গে চলতে-ফিরতে এখন আমরা অনেকেই অস্বস্তি বোধ করি। কিন্তু ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এক্ষেত্রেও এক বিরল ব্যতিক্রম। তিনি নিজের সমালোচনাও সহজভাবে গ্রহণ করতে পারতেন। অন্তরে কারো সম্পর্কে বিদ্বেষ পুষে রাখতেন না।
তার সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের অভিজ্ঞতা থেকে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। ১৯৯৫ সালের দিকে আমি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় ‘ফরহাদ মেমোরিয়াল ক্লিনিক’ নামে একটি সেবামূলক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ নিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাছে পরামর্শ নেওয়ার জন্য গিয়েছিলাম সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। তার সঙ্গে আমার আগে পরিচয় ছিল না। একজন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি যে সম্মতি দিয়েছেন, তাতে আমি খুশি ছিলাম। আমার উদ্দেশ্য শুনে তিনি আমাকে খুব উত্সাহ না দিলেও একেবারে নিরুত্সাহিত করেননি। আমাদের দেশে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়া যে সহজ কাজ নয়, সেটা তিনি গণস্বাস্থ্যে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন। কিছু ভালো পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং গণস্বাস্থ্যের তৈরি বেশ কিছু ওষুধও ফরহাদ মেমোরিয়াল ক্লিনিকের জন্য দিয়েছিলেন।
আমি সিপিবি করতাম শুনে তিনি তার কিছু ক্ষোভের কথাও বলেছিলেন। তিনি এরশাদকে দিয়ে যে ঔষধনীতি করিয়েছিলেন, তার বিরোধিতা করেছিলেন সিপিবি ও আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসকেরা এবং বিএমএ। তখন বিএমএর নেতৃত্বে ছিলেন ডা. সারওয়ার আলী, যিনি ছিলেন সিপিবির একজন বিশিষ্ট নেতা। জাফর ভাই সেদিন বলেছিলেন, সারওয়ার ভাইয়েরা বিরোধিতা না করলে এরশাদের ঔষধনীতি হতো একটি যুগান্তকারী ঘটনা।
বছরখানেক আগে আমি একটি লেখায় জাফর ভাইয়ের একটু সমালোচনা করেছিলাম তার একটি রাজনৈতিক বক্তব্য প্রসঙ্গে। এটা সবার জানা যে তিনি বিএনপির সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা বলা হতো তাকে। কিন্তু তার কোনো পরামর্শ বিএনপি গ্রহণ করেছে বলে মনে হয় না। তবু তার মতো একজন ব্যক্তি কেন যেচে বিএনপিকে পরামর্শ দিতে গিয়ে নিজে লজ্জায় পড়েন, সেই প্রশ্ন আমি করেছিলাম। লেখাটি আজকের পত্রিকায় যেদিন ছাপা হয়, সেদিন জাফর ভাই ফোন করলেন। প্রথমেই আমাকে অভিনন্দন জানালেন লেখাটির জন্য। তারপর মুখোমুখি কথা বলার জন্য চায়ের দাওয়াত দিলেন। একবারও তার যে সমালোচনা করেছি, সেই প্রসঙ্গ তুললেন না। বরং বললেন, দেশের এবং মানুষের ভালোর জন্য সবারই একযোগে কাজ করা উচিত।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলায় বিশেষ ভূমিকা ছিল জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত চিকিৎসকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত করা, হাসপাতালের জন্য ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ করার ক্ষেত্রেও তার বড় ভূমিকা ছিল। যাদের আগে কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না, এমন নারীরা কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েই হাসপাতালে সেবার কাজ করেছিলেন।
বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের সেই অভিজ্ঞতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী কাজে লাগিয়েছিলেন ১৯৭২ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা যে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব, তা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রমাণ করে। এটাও বলা দরকার যে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহায্য করেছিলেন। জমি দিয়েছিলেন। এমনকি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামটিও বঙ্গবন্ধুরই দেওয়া।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করতে চাইতেন সহজভাবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবার জন্য সব ক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রিধারী বা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা চিকিৎসকের দরকার নেই। স্বল্প শিক্ষিত মানুষকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়েও সেবার কাজ পাওয়া সম্ভব। তার হাত ধরেই বাংলাদেশে প্রথম স্বাস্থ্যবিমা চালু হয়। জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার কোনো উদ্যোগকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন গণস্বাস্থ্যের মাধ্যমে গড়ে তোলা সফল স্বাস্থ্য উদ্যোগ সরকারই যেন সারা দেশে প্রয়োগ করে বা ছড়িয়ে দেয়। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জীবনের নানা পর্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার বা সম্মাননা পেয়েছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে জীবনের শেষ বছরগুলোতে রোগব্যাধির সঙ্গে লড়তে হয়েছে। জটিল কিডনি রোগে ভুগছিলেন। মানুষ যেন সহজে প্রতিস্থাপনের জন্য কিডনি পেতে পারেন, সে জন্য তিনি আইনের পরিবর্তন চেয়েছিলেন। পাশাপাশি তার হাতে গড়ে ওঠা গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ১০০ শয্যার কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট তৈরি করেছিলেন। ঐ ইউনিটে নিজেই ডায়ালাইসিস করাতেন। ইউনিটটি তিনি করেছিলেন কম মূল্যে সাধারণ মানুষকে সেবার সুযোগ করে দিতে। একটি ক্যানসার হাসপাতাল করার ইচ্ছাও তার ছিল।
অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার বা সম্মাননা পেয়েছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তবে তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার নিশ্চয়ই মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা পাওয়া। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে সমাজের সব স্তরের মানুষের মধ্যে যে শোক, সহানুভূতি ও শ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটেছে, তা থেকে মনে হয়, আমাদের সবকিছু এখনো নষ্টদের দখলে যায়নি।