‘প্রটেকটিং ইউরোপ’-এর জন্য প্রায় দুই দশক ধরে রুশ সীমান্ত পর্যন্ত ন্যাটোর সম্প্রসারণকে ইউরোপ বাহবা দিয়েছে। ওয়াশিংটন ইউরোপকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে পুর্ণোদ্যমে নামতে চাইছে যখন, ম্যাক্রঁ তখন ‘স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি’র প্রস্তাব করেন। সফল চীনফেরত ম্যাক্রঁর ঘোষণার পশ্চাতে আর কোনো কূটচাল কি রয়েছে, যে ইউরোপকে দলে রাখার জন্য চাপে পড়া যুক্তরাষ্ট্র ‘ছাড়’ দিতে বাধ্য হবে?
বেইজিংয়ে করমর্দনের মাধ্যমে সৌদি-ইরান শান্তি চুক্তির পাকাপাকি স্বীকৃতির প্রায় মাসখানেক বাদে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ তিন দিনের ভ্রমণে বেইজিংয়ে হাজির হন। সঙ্গে আংশিক সফরসঙ্গী ছিলেন ইইউ কমিশনের প্রধান উরসুলা ফন ডের লিয়েন ওরফে ভিডিএল। ৬ এপ্রিল মধ্যাহ্নের আগমুহূর্তে প্রেসিডেন্টের বিমান চীনের রাষ্ট্রীয় অতিথি ম্যাক্রঁ ও তার ৫০ সদস্যের ব্যবসায়ী দলকে বেইজিংয়ে নামিয়ে দেয়। চীনের কূটনৈতিক প্রধান ওয়াং ঈ ম্যাক্রঁকে অভ্যর্থনা জানান এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট লাল কার্পেটে হেঁটে গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন। অতঃপর ফরাসি প্রেসিডেন্ট গ্রেট হলে প্রবেশ করেন। ইত্যবসরে ভিডিএল বাণিজ্যিক বিমানে চেপে বেইজিংয়ে এসে নামেন, চলে আসেন গ্রেট হলে। ইউরোপের দুই নেতা, যার একজন হলেন প্রেসিডেন্ট, অন্যজন ইউরোক্র্যাট। তারা ইউক্রেন যুদ্ধে শি জিনপিংকে ন্যাটোর সারিতে যোগদানের পিটিশন দাখিল করেন! শি অবশ্য মার্জিতভাবে সেই আবেদন খারিজ করে দেন। পরদিন ৭ এপ্রিল উরসুলা ভিডিএল সোলো সংবাদ সম্মেলন করে বাণিজ্যিক বিমানে চেপে ঘরে ফিরে যান। শির দাওয়াতে অপরাহ্নে ম্যাক্রঁ চলে যান গুয়াংডন প্রদেশের গুয়াংজৌ সিটির (ক্যান্টন শহরের) ‘পাইন গার্ডেনে’।
বসন্তকালে গুয়াংজৌ মৃদুমন্দ বাসন্তী হাওয়া, দ্যুতিময় রোদ আর উপচে পড়া ফুলের প্রাচুর্য নিয়ে প্রীতিকর জাদু শহরের সাজ নেয়, আর এই শহরের বাইইয়ুন পর্বতমালার পাদদেশে, লেকের ধারে অবস্থিত পাইন গার্ডেন। আনন্দ দেওয়া, উল্লসিত হওয়ার মতো প্যাভিলিয়ন ও জলপ্রপাতে সমৃদ্ধ গার্ডেনটিও মন্ত্রমুগ্ধ করতে কম যায় না কিন্তু! এই জাদুরাজ্যে শি ম্যাক্রঁর সঙ্গে ঘরোয়া মিটিং করেন।
দুই প্রেসিডেন্ট এই গার্ডেনে রিল্যাক্সিং মুডে হেঁটে বেড়ান, গপ্পসপ্প করেন এবং মাঝেমধ্যে হাঁটা থামিয়ে গার্ডেনের চারদিকে ছড়িয়ে থাকা সৌন্দর্য উপভোগ করেন।
অতঃপর, একসময় ‘গুকিন’-এ (Guqin) কয়েক হাজার বছরের পুরোনো ‘লফটি মাউন্টিনস অ্যান্ড ফ্লোয়িং স্ট্রিমস’-এর সুরেলা মেলোডিকে অনুসরণ করে তারা ‘বাইইয়ুন হলে’ চলে আসেন (ইঙ্গিত:সেতার, সরোদের বাজনা যারা ভালোবাসেন, তাদের গুকিনের বাজনা ভালো লাগবে)। বাইইয়ুন হলের ‘ফয়ার’-এ বেতের চেয়ারে বসে ট্র্যাডিশনাল চীনা চা পান করতে করতে বিগত এক হাজার বছরে ক্ষমতার উত্থান-পতন নিয়ে তাদের আলোচনা হয়। শির মারফতে ম্যাক্রঁ চীনের ইতিহাস সম্বন্ধে সম্যক উপলব্ধি অর্জন করেন; যেমন—১ হাজার বছর আগে ‘ম্যারিটাইম সিল্ক রোডের’ সূত্রপাত হয় গুয়াংজৌতে; এবং ১০০ বছর আগে চীন গুয়াংজৌতেই আধুনিক অগ্রগতির প্রথম দরজাটি খুলে দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। ম্যাক্রঁকে শি চৈনিক আধুনিকীকরণের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য ও মর্মবস্তুর ব্রিফিং দেন।
চীনা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য মেলা, আন্তর্জাতিক আমদানি এক্সপো ইত্যাদি হরেক রকমের বাণিজ্য মেলায় ফ্রান্সকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ দেন শি। পরিতৃপ্ত ম্যাক্রঁ বলেন, পরস্পরকে বুঝতে পারা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধই হলো যথার্থ বন্ধুত্ব। ফ্রান্স ও ইউরোপের অটোনমি এবং একতা বজায় রাখার প্রশ্নে চীনের অকৃত্রিম সমর্থনকে ধন্যবাদ দেন ম্যাক্রঁ। বলেন যে ফ্রান্স তা উপলব্ধি করে, মূল্য দেয়।
ডিনার খেতে খেতেও তাদের আলোচনা চলতে থাকে।
ম্যাক্রঁকে শি বলেন যে ফ্রান্সের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ স্ট্র্যাটেজিক যোগাযোগ বজায় রাখতে এবং চীন-ফ্রান্স সমন্বিত স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপকে নতুন উচ্চতায় উন্নীত করতে তিনি প্রস্তুত। শির কথায় সায় দিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট বলেন, তিনিও প্রস্তত। এবং আগামী বছর শি জিনপিংকে ফ্রান্স ভ্রমণের দাওয়াত দেন।
সর্বোচ্চ কূটনীতিক ওয়াং ই এবং কিন গাংসহ অন্যদের উপস্থিতিতে দুই পক্ষ একটি যৌথ স্টেটমেন্ট ঘোষণা করে।
মার্চ মাসে ‘নো লিমিট’ চীন-রাশিয়া পার্টনারশিপের প্রবৃদ্ধিতে ইইউর নার্ভাস দেশগুলো চীনের সঙ্গে নিজস্ব কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে যত্নবান হয়। বিভিন্ন দেশের লিডারদের বেইজিং ভ্রমণের লম্বা তালিকাভুক্তদের মধ্যে ম্যাক্রঁ-ভিডিএলের দ্বৈত ভ্রমণও ছিল।
ফিরতি যাত্রায় ম্যাক্রঁ তার ‘এ ৩৩০’ বিমানে সাংবাদিকদের বলেন, ইউরোপকে ‘স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি’ পেতে হবে এবং তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মুখোমুখি সংঘর্ষের সঙ্গে ইউরোপকে জড়িয়ে পড়া চলবে না। মার্কিন পরিচালিত নতুন তাইওয়ান সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে অনাগ্রহ প্রকাশ করা ছাড়াও ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ তাইওয়ানের পাশাপাশি চীনের অবস্থান সম্বন্ধে তার উপলব্ধি সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করেন। বলেন, ‘আমরা ইউরোপীয়রা আমাদের জন্য গুরুত্ববহ হলো একতা। চীনাদের জন্যও গুরুত্ববহ হলো তাদের একতা এবং তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে তাইওয়ান হলো তাদের একতার একটি উপাদান।’
তিনি এ-ও বলেন, ইউরোপকে ‘ডলারের এক্সট্রা টেরিটোরিয়ালিটি’র ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। কারণ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া, চীন, ইরান ও অন্যান্য দেশে নিষেধাজ্ঞাগুলো আরোপ করা হয়, যাতে ডলারভিত্তিক বৈশ্বিক আর্থিক সিস্টেমে তারা প্রবেশাধিকার হারায়। ফলস্বরূপ, ইউরোপের কোম্পানিগুলোকে সেসব দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞা এড়াতে বাণিজ্যিক গাঁটছড়া কেটে দিতে বাধ্য হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ, উভয়েই ‘এক চীন’ মূল তত্ত্ব অনুমোদন করে বটে, কিন্তু সেটিকে উত্তরোত্তর দুর্বল করার মার্কিন প্রচেষ্টায় ইইউ সহযোগিতা করে আসছে। যেমন :মার্কিন সমর্থনের জোরে লিথুয়ানিয়া ‘তাইওয়ান প্রতিনিধি অফিস’ খোলার অনুমতি দেয়, বা ৫জির ক্ষেত্রে সমগ্র ইইউর পরিবর্তে সদস্য দেশগুলোকে দ্বিপাক্ষিকভাবে, কখনো একতরফা কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে ‘হুয়াভেই’য়ের ৫জি ব্যবহার রোধ করা হয়। এমন আরো অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। অথবা ২০১৩ সাল থেকে ‘কমপ্রিহেনসিভ অ্যাগ্রিমেন্ট ওন ইনভেস্টমেন্ট’-এর মতো জরুরি চুক্তিটি ইইউ অদ্যাবধি সত্যাকৃত (র্যাটিফিকেশন) করেনি।
চীনবিরোধী মানসিকতার সূত্রপাত হয় প্রেসিডেন্ট ওবামার আমল থেকে, বৈদেশিক মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ‘পিভট টু এশিয়া’ প্রজেক্টের মাধ্যমে। ম্যাক্রঁর ইউরোপীয় স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি সংশ্লিষ্ট মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন রাজনীতিক ও মিডিয়ায় মহা হইচই পড়ে যায়। যেমন :
নিউ ইয়র্ক টাইমস (৮.৪.২৩) টিপ্পনী করে ম্যাক্রঁকে প্রেসিডেন্ট শার্ল দি গ্যলের ধ্বজাধারি বলে অভিযুক্ত করে (সবকিছুতে ন্যাটোর নাক ঢোকানোর প্রতিবাদে দি গ্যল ন্যাটো থেকে ফরাসি প্রতিনিধিত্ব তুলে নিয়েছিলেন।), বা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল (৯.৪.২৩) ম্যাক্রঁ বোকার মতো কাজ করেছে বলে এবং তিনি ‘চৈনিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ডিটারেন্সকে দুর্বল করেছেন, ফলে ইউরোপের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকেও দুর্বল করা হয়েছে।’ বা উত্তেজিত সিনেটর বলেন, ‘ওকে, তোমরা ইউরোপীয় নেতারা তবে ইউক্রেন সামলাও, আমরা চৈনিক আগ্রাসনে মন দেব।’
প্রকৃতপক্ষে বাস্তবতা অবশ্য নাটকীয়ভাবেই ভিন্ন। ইউরোপের নিষ্কর্মা নেতারা অন্ধ বশংবদের মতো ওয়াশিংটনের অ্যাজেন্ডা গ্রহণ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নিকৃষ্টতম প্রক্সিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে; স্ট্র্যাটেজিক রুশ-ইউরোপ শক্তি-বাণিজ্য ধ্বংস করে; নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের রহস্যজনক ধ্বংসকে মেনে নেয়। একইভাবে, ‘প্রটেকটিং ইউরোপ’-এর জন্য প্রায় দুই দশক ধরে রুশ সীমান্ত পর্যন্ত ন্যাটোর সম্প্রসারণকে ইউরোপ বাহবা দিয়েছে। ওয়াশিংটন ইউরোপকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে পুর্ণোদ্যমে নামতে চাইছে যখন, ম্যাক্রঁ তখন ‘স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি’র প্রস্তাব করেন।
সফল চীনফেরত ম্যাক্রঁর ঘোষণার পশ্চাতে আর কোনো কূটচাল কি রয়েছে, যে ইউরোপকে দলে রাখার জন্য চাপে পড়া যুক্তরাষ্ট্র ‘ছাড়’ দিতে বাধ্য হবে? ম্যাক্রঁর ঘোষণা ও কমেন্টগুলোর জবাবে তাই কি ওয়াশিংটনের উত্তপ্ত উত্তেজনা, রাগ, রোষ হতাশাগ্রস্ত ‘অধিকারসূচক প্রেমিকে’র কথা মনে করিয়ে দেয় না নাকি!