১৯৪৮ সালের ৬ জুন। বর্তমান টাঙ্গাইল জেলা তখন ময়মনসিংহের একটি মহকুমা। এ মহকুমার অধীনে গোপালপুর থানার মুশুদ্দী ইউনিয়নের (বর্তমানে ধনবাড়ী উপজেলা) পঁচাপোটল গ্রামের জমিজমা নিয়ে মারামারির মামলা ছিল ময়মনসিংহ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। মামলার বাদি পঁচা মণ্ডল বিবাদী পঁচু শেখ। বিবাদী পক্ষের উকিল শ্রী পাঁচু বাবু। সাক্ষীর দিন উকিল পাঁচু বাবু বাদিকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনার নাম?’
পঁচা মণ্ডল’
‘গ্রামের নাম?’
‘পঁচাপটোল’
‘মারামারিটা হয়েছিল কোথায়?’
‘পঁচাবিলে’
উকিল পঁচা বাবু সঙ্গে সঙ্গে বিচারকের উদ্দেশে নিবেদন করেন, মহামান্য আদালত মামলার আরজিতে বলা হয়, মারামারি হয়েছে পঁচা খালে। পুলিশি তদন্তে মিলেছে পঁচা কুড়ি; কিন্তু বাদী এখন বলছেন পঁচাবিলের কথা। আসলে এ তিন পঁচার কোনোটিতেই পঁচা বনাম পঁচুর মধ্যে মারামারি হয়নি। বাদি পঁচা মণ্ডল বলেন, হুজুর আদালত পঁচাকুড়ির জমিতে আবাদ করা পটোল তুলতে পঁচা খাল পার হতে হয়। আর তিনি পঁচা খালে পৌঁছা মাত্র পঁচাকুড়িতে অবস্থান করা পঁচু দলবল নিয়ে এসে পঁচাখালে তার ওপর হামলা চালায়। পরে বিচারক তার রায়ে লিখেন, ‘মারামারিটা পঁচা কুড়িতে না পঁচা খালে, না পঁচা বিলে হয়েছে—সাক্ষ্যে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। তাই বিবাদী পঁচু শেখকে মামলা থেকে খালাস দেওয়া হলো।’ এ মামলার রায়ের মুখরোচক খবর এলাকায় এখনো প্রবাদপ্রতিম। শুধু স্থান-নাম বিভ্রান্তি নিয়ে মামলার রায়ের ঘটনাটি হাস্যরসাত্মক হিসেবে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন ইতিহাস ও লেখালেখিতে স্থান পেয়েছে।
গাঙ্গেয় উপদ্বীপ বাংলাদেশ একদিনে গড়ে ওঠেনি। প্রাচীন বরেন্দ্র ভূমি, গেরোয়া মাটির মধুপুর গড় এবং সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়া সারা দেশ সাগর আর নদীর পলিতে ক্রমান্বয়ে জেগে ওঠে। ‘বং’ থেকে ‘বঙ্গ’ আর ‘বঙ্গ’ থেকে যে ‘বাংলা’ সে বাংলায় হাজারো গ্রাম, হাজারো জনপদ গড়ে উঠেছে হাজার বছর ধরে জনবসতির ক্রমান্বয় বিস্তৃতির মাধ্যমে। ড. সুকুমার সেনের ভাষায়, ‘স্থান-নামে এক শব্দময় এবং বহু শব্দময়তার গাঁথুনি রয়েছে। মানুষ যখন সামাজিকভাবে জীবনযাপন শুরু করে তখন তার বাসস্থান চিহ্নিত করার জন্য দরকার হয় স্থান নামের। বসতি স্থাপনের শুরু থেকে ক্রমবিকাশের নানা ধারায় গ্রাম, মহল্লা, পাড়া বা বাড়ির নাম পরিচিতি লাভ করে।’ ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের মতে, ‘বাংলার জলাঙ্গী যখন দ্বীপ হয়ে উঠল তখন মধ্যবর্তী জলভাগ গাঙ্গ বা খাল নামে পরিচিত হলো। যেমন গাঙ্গাপাড়া, গঙ্গাবর, গাঙ্গাইর, মধুখালী, ভূতখালী এবং পেচাখালী। যখন পলি জমে উচ্চভূমির সৃষ্টি হলো তখন ডাঙ্গা বা চর দিয়ে নাম শুরু হলো। যেমন চাপাইডাঙ্গা, তুলসীডাঙ্গা, কৈডাঙ্গা অথবা চরপাড়া, চরমতি, চরভিউলী। উর্বর দ্বীপের বনজঙ্গল পরিষ্কার করে যখন আবাদ শুরু হলে তখন দিয়া, দহ, চক বা কাটি যুক্ত হলো। যেমন কালদিয়া, বেলদিয়া, বলদিয়া, কালাদহ, নুপুরদহ, জমদহ অথবা চককাশি চকসুমুন্দী, চকপাড়া অথবা ঝালকাঠি, রূপকাঠি, স্বরূপকাঠি ইত্যাদি।’ আরো পরে জনপদের নামের সঙ্গে যুক্ত হলো পাড়া, বাড়ী, গ্রাম, নগর, পুর। যেমন সীমান্তপাড়া, খায়ের পাড়া, যোগীপাড়া, সেনবাড়ী, হরিদেববাড়ী, ব্রাহ্মণবাড়ী, নবগ্রাম, মেঝো গ্রাম, হলদি গ্রাম, রংপুর, সোনাপুর, যাদবপুর। আবার পাহাড়ি এলাকায় বাইদ, চালা বা কুড়ি নাম খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যেমন মনার বাইদ, বোকার বাইদ, কালার বাইদ, দীঘল বাইদ, গজারী চালা, হুতুমচালা, অজগর চালা, শোলাকুড়ি, হাগড়াকুড়ি, নতুন কুড়ি ইত্যাদি। আবার বন্যপ্রাণী বা জীবজন্তুর নামেও গড়ে ওঠে জনপদ। যেমন হাতীবান্ধা, হাতীপাড়া, হাতীখোলা, বাঘমারা, বাঘডোবা, বাঘদহ, হরিণপাড়া, হরিণধরা, হরিণাতলা, কুমিরগাছা, কুমিরপাড়া, কুমিরধরা, অজঘরপাড়া, সাপধরা, সাপমোচন, ভালুকজান, ভালুকা, ভালুকখানা, মহিষমারা, মহিষধরা, মহিষখানা। আবার গাছপালার নামেও জনপদের নামকরণ হয়ে থাকে। যেমন গজারীচালা, সুন্দরী, সোনালু, কলাপাড়া, কাঁঠালগাছি, জামপাড়া। তাই বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি জনপদ, প্রতিটি মহল্লা একেকটি ইতিহাস, ঐতিহ্য, উপাখ্যান, পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ঘটনাপ্রবাহ, নদনদী, পাহাড়, খালবিল, ঝিল, চালা, ভিটা, ফুলফল, বৃক্ষলতা, গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী, পবিত্র তীর্থস্থান, অথবা নামকরা রাজাবাদশা, জমিদার-তালুকদার, দুর্গ-কেল্লা, অথবা সাধক, আউলিয়া, বিখ্যাত বংশ বা গোষ্ঠীর নামে নামকরণ হয়েছে। এসবের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে নানা লোককথা, সমৃদ্ধ লোকজীবন, অনাবিষ্কৃত লোকসংস্কৃতি এবং স্থানীয় ইতিহাসের বহুবিধ উপাখ্যান।
টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার নামকরণ নিয়ে কথা উঠলে বলা হয়, জেলায় এক দুয়ার দেলদুয়ার, এক হাতী কালিহাতী, এক বাড়ী ধনবাড়ী। তিন আইল টাঙ্গাইল, ঘাটাইল, বাসাইল। ৬ পুর গোপালপুর, মধুপুর, ভূঞাপুর, নাগরপুর, মির্জাপুর ও সখিপুর। কোনো কোনো গ্রাম-নাম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কখনো-সখনো মশকরা করা হয়। যেমন—গোপালপুরের চোরের ভিটা, ঘাটাইলের বেশ্যারচালা, ধনবাড়ীর কলহকূড়া, ভূঞাপুরের গোবরধন, কালিহাতীর ভণ্ডেশর নিয়ে সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে বেশ কবার কছলাকছলি হয়েছে। তবে সব মানুষের কাছে তার গ্রাম পবিত্র, মায়াময়, ছায়াময়। তাই কবির ভাষায় বলে থাকেন ‘আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন, মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন।’ তবুও অনেক সময় দুষ্টজনের জন্য গ্রামের বদনাম হয়। তখন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা হয়, ‘গ্রাম নষ্ট করে কানায় আর বিল নষ্ট করে পানায়’।