মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও তথ্যসমৃদ্ধ বিষয়বস্তু যথাযথভাবে উপস্থাপন করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করার জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট ও সুপরিকল্পিত কর্মসূচি। দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে লক্ষ্য দল হিসেবে নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক পাঠদান, আলোচনা, সেমিনার, উত্সব আয়োজনের উদ্যোগকে গুরুত্ব দিতে হবে। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের সঠিক তথ্যপ্রবাহ সঞ্চালনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। তরুণ প্রজন্মকে দেশপ্রেমের মহিমায় উজ্জীবিত করতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস ও তথ্যপ্রবাহ জানা ও অনুধাবন অতীব প্রয়োজনীয়। সেই লক্ষ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচনা, সেমিনার, উল্লেখযোগ্য কিছু প্রকাশনা দেখা গেলেও প্রাতিষ্ঠানিকতার অভাব পরিলক্ষিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ ও আত্মপ্রকাশ এর বিষয়বস্তু এবং ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ সংযুক্ত করার ওপর সচেতন মহল ইতিমধ্যে গুরুত্বারোপ করেছে। মূলত ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণা এবং তার ওপর ভিত্তি করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ন ও সরকার গঠন, সর্বোপরি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানিক প্রকাশ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বর্তমান স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সমগ্র ইতিহাসকে প্রধানত তিনটি অধ্যায়ের মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে। (১) প্রথম অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব স্বাধীনতা সংগ্রাম। (২) দ্বিতীয় অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা। (৩) তৃতীয় অধ্যায় বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের মহানায়ক স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পূর্বাপর ঘটনার সঠিক ইতিহাস উপস্থাপন।
প্রথম অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব আন্দোলন-সংগ্রামে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ’৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে ’৬৬-র বঙ্গবন্ধুর ‘ব্রেন চাইল্ড’ ঐতিহাসিক ৬ দফার মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার যে ইতিহাস, তা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করা বর্তমান প্রজন্মের জন্য জরুরি। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফাই ছিল স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতার মূল প্রেরণা। মূলত ৬ দফার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন এবং আপামর বাঙালি আস্থা রেখেছিল তার নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ওপর জনগণের আস্থা এবং জনগণের ওপর বঙ্গবন্ধুর আস্থা অর্জনই ছিল ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ। আর এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা ঘোষণা’, ২৬ মার্চের ‘প্রশাসনিক স্বাধীনতা ঘোষণা’, ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ন এবং সরকার গঠন। সর্বোপরি ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ওপর ভিত্তি করে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হয়, তা মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক দলিল হিসেবে বিবেচিত। বলা বাহুল্য, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রই বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান। আর এই ঘোষণাপত্রের প্রতিটি ধাপে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরে তার যথার্থতা উপস্থাপন করা হয়েছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত এই ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব প্রদান করে সরকার গঠনসহ বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিবর্গ নিয়োগের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতার যথার্থতার উল্লেখ আছে। এছাড়া আছে যুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনার নির্দেশনা। সুতরাং এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তিমূলেই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার তথা মুজিবনগর সরকারের আত্মপ্রকাশ এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ। এই আলোচনার শুরুতে তিনটি অধ্যায়ের কথা বলেছিলাম। এই তিন অধ্যায়ই গুরুত্বপূর্ণ, তবে শেষ অধ্যায়টি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনাসহ যথাযথ উপস্থাপন ও বাস্তবায়ন বর্তমানে খুবই প্রাসঙ্গিক। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেছে, একদিকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি, অন্যদিকে সামগ্রিক উন্নয়ন। এসব বিষয় মাথায় রেখে আগামীর বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর করতে প্রয়োজন শিক্ষিত ও দক্ষ তরুণ প্রজন্মের। আর এই দক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর তরুণ প্রজন্ম গড়তে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্ব দিতে হবে, আনতে হবে আমূল পরিবর্তন। যে শিক্ষাব্যবস্থায় থাকবে বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির যথাযথ উপস্থাপন। এক্ষেত্রে মহান স্বাধীনতার সংগ্রামে আমাদের জাতির পিতার নেতৃত্ব, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সংগ্রামের ঘটনাপ্রবাহ এবং স্বাধীনতা অর্জনবিষয়ক ইতিহাস সংযুক্তি গুরুত্ববহ। এই শিক্ষার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠবে কাঙ্ক্ষিত তরুণ প্রজন্ম। সে লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে এখন প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। অর্থাৎ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও মাদ্রসা শিক্ষার পাঠ্যপুস্তকের কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং ১৭ এপ্রিলের ঐতিহাসিক ঘঠনাপ্রবাহ। একই সঙ্গে সব সামাজিক, সাংস্কৃতিক এমনকি প্রশাসনিক দপ্তরকেও এর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আর তাহলেই ইতিহাসের যথার্থতায় গড়ে উঠবে তরুণ প্রজন্ম।