দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পরে পবিত্র ঈদুল ফিতর কড়া নাড়ছে। ঈদ উপলক্ষ্যে নারীর টানে লাখ লাখ মানুষ শহর থেকে গ্রামের উদ্দেশে রওনা দেয়। কেউ লঞ্চে, কেউ গাড়িতে, কেউ ট্রেনে। সারা বছর শহরে তথা পরিবারের বাইরে থাকায় ঈদ উপলক্ষ্যে কর্মজীবী মানুষ চায় পরিবার-পরিজন সঙ্গে নিয়ে নিশ্চিন্তে কিছু সময় কাটাতে। দুঃখজনক বিষয় হলো, ঈদ এলেই বেসরকারি সব পরিবহন খাতে ভাড়া বেড়ে যায় কয়েক গুণ। রাস্তায় নেমে আসে লাইসেন্সবিহীন হাজারো গাড়ি, যেগুলোর চালক থাকেন পুরোপুরি অদক্ষ এবং অধিকাংশ লাইসেন্স ছাড়া।
বাস কোম্পানিগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য থাকে দ্রুততার সঙ্গে যাত্রী আনা-নেওয়া করা। এক কোম্পানি আরেক কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রধান সড়কগুলোতে প্রতিনিয়ত গাড়ি চালিয়ে থাকে, যার ফলে রাস্তায় হুটহাট করেই মানবসৃষ্ট এই কৃত্রিম দুর্ঘটনা ঘটে। ঈদ-পূর্ববর্তী সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের প্রতি বছরের নিয়মিত ঘটনা।
অন্যদিকে দেখা যায়, লঞ্চ কোম্পানিগুলো তাদের ত্রুটিযুক্ত লঞ্চ রংচং মাখিয়ে চালানো শুরু করে দেয়। এক জনের যায়গায় ছয় জন ওঠানো হয় লঞ্চে। এমন কোনো যায়গা নেই, যেখানে যাত্রী থাকে না। সহজভাবে বললে, ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ যাত্রী নিয়েই এমন ত্রুটিযুক্ত লঞ্চ ঢাকা থেকে ছেড়ে গন্তব্যমুখী চলাচল শুরু করে। ফলস্বরূপ, কখনো কখনো পথিমধ্যে ঘটে যায় নানান অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। শত শত পরিবারের সঙ্গে ঘটে যায় জীবনের সবচেয়ে নির্মম ঘটনা।
এছাড়া ঈদযাত্রায় দেখা যায় লঞ্চের কেবিনগুলোতে নানান অপ্রিতকর ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে নানান সময়ে নানান সিদ্ধান্ত এলেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং দেখা যায়, কেবিনকে পুঁজি করে অনেক লঞ্চের স্টাফরাও নানান অপ্রিতকর ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু রুচিহীন, ব্যক্তিত্বহীন মানুষ নানান সময়ে নানান অনৈতিক কাজ করে। এমনকি দেশবাসী এমন ঘটনারও সাক্ষী—কেবিনে লাশ পড়ে আছে, সঙ্গে থাকা যাত্রীর হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে ঈদকে কেন্দ্র করে সড়ক ও নদীপথে বেড়ে যায় চোর, ডাকাতসহ বিভিন্ন চক্ররে উপদ্রব। কখনো চুরি, কখনো ডাকাতি, কখনো বা শারীরিক হেনস্তা কিংবা লঞ্চের কেবিনে রেখে ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো ঘটে প্রতি বছর। যেই বিষয়গুলোর ওপর প্রসাশনের তেমন কোনো গুরুত্ব বা নজরদারি না থাকায় প্রতি বছরই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়ে থাকে অসাধু এই চক্র।
ঈদ মানেই আনন্দ। আর সেই আনন্দ তখনই বরবাদ হয়ে যায়, যখন কোনো একটা পরিবার কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার স্বীকার হয়। ঈদ উপলক্ষ্যে প্রসাশনকে যেমন তৎপর হতে হবে, ঠিক তেমনি আমাদের সচেতন হতে হবে। সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে গেলে পরবর্তী বাস, ট্রেন বা লঞ্চের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বেশি টাকা হাতে বা মানিব্যাগে না রেখে ব্যাংকে অথবা এটিএম কার্ডে রাখা নিরাপদ হবে। বাচ্চা সঙ্গে থাকলে তাদের নিরাপত্তার জন্য পরিবারের লোকজনকেই সজাগ এবং সতর্ক হতে হবে। পাশাপাশি দেখা যায় লঞ্চ বা গাড়ি থেকে নেমেও বাড়ি পৌঁছার বাকি পথটুকু নিরাপদে পৌঁছার জন্য পরিবারের লোকজনের সাহায্য নিতে হবে। তাদের সার্বক্ষণিক জানাতে হবে কখন কোথায় অবস্থান করছে এবং সুবিধা-অসুবিধাসমূহ।
প্রসাশনের এই সময়ে সতর্ক থাকা একান্ত জরুরি। গুরুত্বপূর্ণ ও অনিরাপদ যায়গাগুলোতে তাদের লোকবল রাখতে হবে। যে কোনো সমস্যা যে কোনো মুহূর্তে তাদের জানানোর জন্য বিভিন্ন হেল্পলাইন খুলতে হবে। রাস্তাগুলো ভাঙা থাকলে সেগুলো অতিদ্রুত সংস্কার করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে দক্ষিণ বঙ্গের বড় একটা অংশ এখন বাসে যাওয়া-আসা করে। তাই পরিবহন সেক্টরের দায়িত্বশীল সবাইকে মানুষের জীবনের গুরুত্ব অনুধাবন করে ধীরেসুস্থে ও নিরাপদভাবে গাড়ি চালাতে হবে। সীমার বাহিরে গিয়ে যাত্রী তোলা যাবে না। রাত্রীবেলা চালককে ঘুম থেকে মুক্ত রাখতে যাত্রাবিরতি এবং কিছুক্ষণ পরপর মুখ ধোঁয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। যেই বিষয়টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন হেল্পারসহ বাসের দায়িত্বশীল লোকজন। আরেকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয় মাথায় রেখে বাস, লঞ্চ ও ট্রেনে পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপত্তাকর্মী ও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখতে হবে।
ঈদ উৎসব সবার মাঝে ছড়িয়ে যাক। পারস্পরিক মেলবন্ধন তৈরি হোক ঈদ ঘিরে। এই সুন্দর মুহূর্তের আনন্দ, অনুভূতি, মায়া, ভালোবাসা ছড়িয়ে যাক সমগ্র দেশে। সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগাম শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।