ঠাঁই নেই, তবুও যেতে হবে। বাসে, ট্রেনের কামরায় ভেতরে দাঁড়িয়ে, সেখানে ঠাঁই না হলে ছাদে। লঞ্চেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফ্লোরে বসে, ডেকে দাঁড়িয়ে এমনকি ছাদের ওপর বিছানা পেতে সেখানেই গন্তব্যের জন্য বসে পড়া। ঈদকে সামনে রেখে প্রতি বছর একই অবস্থা হয়। যেভাবেই হোক বাড়িতে পৌঁছাতেই হবে। এ টান যে বড়বেশি প্রাণের। এ টান নাড়ির। দুনিয়ার কোথাও কি মানুষ এভাবে ছুটে প্রাণের টানে, শেকড়ের সন্ধানে? কীসের এত মায়া? কীসের জন্য মানুষের এই ঘরে ফেরার আকুতি? সেকি কেবলই প্রিয়জনের সান্নিধ্য? নাকি তারও অতিরিক্ত কিছু?
কী শোভা কী ছায়া গো, কী স্নেহ হয় কী মায়া গো, কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে।’ ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রামকে দেখার জন্য আকুতি? ইট-কাঠ-পাথরের এই শহর ছেড়ে মুক্তভাবে শ্বাস নেওয়ার জন্য? নাকি জীবনানন্দের বনলতা সেনের মুখোমুখি বসার মতো ‘দুদণ্ড শান্তির’ জন্য এই যাত্রা? যারা গ্রাম থেকে শহরে আসে তাদের প্রাণটা আসলে পড়ে থাকে গ্রামেই। বিশেষ করে যারা গ্রামে বড় হয়েছেন। এই নাগরিক জীবন হয়তো অনেক কিছু দেয়। শিক্ষা-দীক্ষা, ভাত-কাপড়, রুটি রোজগারের নিশ্চয়তা। অনেক উত্তেজনা। ভোগ বিলাস আনন্দ। কিন্তু জীবনের সব পাওয়া, সব তৃষ্ণা কি মেটে তাতে? কিছুই কি বাকি থাকে না?
এই শহরে তো দিগন্তবিস্তৃত মাঠ নেই, জোয়ার ভাটায় দোলে ওঠা নদী নেই, বৃক্ষের শ্যামল ছায়া নেই, ধানের খেতে রোদ ও ছায়ার লুকোচুরি খেলা নেই, ঘাসের ডগায় শিশির নেই, রাখালের বাশের বাঁশি নেই, গোধূলির আলো নেই, বাউকুড়ানির ডগায় ঝরা পাতার নৃত্য নেই, পাখির কলকাকলি নেই, পিঠেপুলি পাটিসাপটার আয়োজন নেই, আউল, বাউল জারি, সারি, ভাটিয়ালির হৃদয় উদাস করা সুর নেই, বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ নেই, নেই এক চিলতে উঠোন। এসব নেই—এর পাল্লা এতটাই ভারী যে, তা বলে শেষ করার নয়।
নাগরিক সুযোগ সুবিধার অনেকখানিই পাওয়া যায় এখন গ্রামে বসেই। বিদ্যুৎ পৌঁছেছে বেশির ভাগ গ্রামেই। সে জন্য বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন। সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন । কম্পিউটার, সঙ্গে ওয়ারলেস ইন্টারনেট সংযোগ। মফস্বলে দৈনিক পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধিরা এখন হাতে লিখে, ফ্যাক্স করে সংবাদ পাঠান না। কম্পিউটারে কম্পোজ করে ইন্টারনেটে ইমেইলের মাধ্যমে অতিদ্রুত তারা পাঠিয়ে দেন খবরাখবর। ব্যবসাবাণিজ্যের খবরও চলে মোবাইলে। মত্স্যচাষি, পোলট্রি ফার্মের মালিক, কিংবা সবজিচাষি মোবাইলে জেনে নেন কেমন বাজার যাচ্ছে।
শিশির ভেজা সবুজ ঘাস, ছোট্টবেলার স্কুলে যাওয়ার মেঠো পথের স্মৃতি, হাডুডু আর ফুটবল খেলার মাঠ, কিংবা টাকার অভাবে পড়তে না পারা স্কুলজীবনের সেই সহপাঠীর প্রিয়মুখ দেখার আনন্দ কোথায় পাওয়া যাবে এই শহরে। এই শহরে নির্ভেজাল জীবনানন্দ কোথায়? এখানে তো মানুষ নয়, শোষক আর শোষিত, আমলা আর কামলা (মজুর), মালিক-শ্রমিক, পুঁজিপতি আর নিঃস্ব, হাইরাইজ বিল্ডিং বনাম রেললাইনের পাশের বস্তির বিস্তর ব্যবধানের মধ্যে সরকার কিংবা বিরোধী দলের শিলপাটার ঘষাঘষির মধ্যে বাস। যানজট আর জনজটে রাস্তায় চলাই দায়। ঘুষখোর কর্মকর্তা ইলিশ কেনে ১৪ হাজার টাকা হালি, আর সাধারণের পুঁটি কিনতেই নাভিশ্বাস।
ঐসব খেটে মানুষের জীবনেও ঈদ আসে। তারাও ঘরে ফেরে। আসলে এই যে এতসব ঝক্কি-ঝামেলা সহ্য করে ঘরে ফেরা এটাও তো দেশপ্রেমেরই অংশ। আমরা তো আমাদের মায়ের কাছেই ফিরি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ফিরে চল মাটির টানে যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।’ দেশও তো মায়ের সমতুল্যই। মা ছাড়া আর কারো জন্য কি এভাবে জীবন বাজি রাখা যায়? একাত্তরে যা করেছেন বীর বাঙালি।
চারদিকে এখন মূল্যবোধের অবক্ষয়। এ জন্য মনুষ্যত্ববোধের উন্মেষ ঘটাতে হবে। এটা করতে হলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। আর জ্ঞানের আধার হচ্ছে পাঠাগার। গ্রন্থাগার হচ্ছে লেখক, পুস্তক ও পাঠকের সম্মিলনস্থল। সভ্যতার দর্পণ। একটি দেশ তথা সমাজের সার্বিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্রও এই পাঠাগার। সমাজের বিত্তবান অনেকেই আছেন যারা তাদের অর্জিত অর্থের একটা অংশ বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করেন। সে ক্ষেত্রে পাঠাগার হতে পারে উত্তম জায়গা। সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে, তার থেকে অন্ধকার দূর করতে হলে পাঠাগার হতে পারে অন্যতম আলোকবর্তিকা।
এ জন্য ঈদে যারা গ্রামে ফিরবেন বিশেষ করে বিত্তবান মানুষরা প্রচেষ্টা চালাতে পারেন নিজ নিজ এলাকায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আজকের একজন তরুণ-তরুণী যেন বইয়ের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠতে পারে সেজন্য পাড়া মহল্লায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। সমাজে সৌহার্দ আর সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে পাঠাগার। আমরা আমাদের সমাজটাকে যতই জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধাররূপে গড়ে তুলতে পারব ততই সমাজ এগিয়ে যাবে। আর একটি উন্নত সমাজ ব্যবস্থায় উৎসব হবে আরো আনন্দময় এবং অর্থপূর্ণ। শেকড়ের টানে ঘরে ফেরাও তখন সার্থক হবে। আমাদের লক্ষ্য হোক সেই দিকে।