সম্প্রতি ঈদ, থার্টি ফার্স্ট নাইট, পূজা-পার্বণ উদযাপনকে কেন্দ্র করে আতশবাজির প্রচলন সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। মূলত, আতশবাজি, পটকা হচ্ছে—নিম্নমাত্রার বিস্ফোরক নান্দনিক এবং বিনোদনমূলক উদ্দেশ্যে বহুলব্যবহৃত এক ধরনের বাজি। আতশবাজির প্রচলন অনেক আগে থেকেই রয়েছে। ইতিহাসে দেখা যায়, আজ থেকে প্রায় ২ হাজার বছর আগে চীনা দেশীয়দের ধারণা ছিল—অনাবৃষ্টি, মহামারি, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয় অপদেবতাদের অপকর্মের ফলে। যার দরুন তারা এসব অপদেবতাদের ভয় দেখাবার উদ্দেশ্যে আতশবাজি ও পটকা ফাটাত। কালভেদে এই বঙ্গদেশেও আতশবাজি, পটকার ব্যবহার শুরু হতে থাকে । যদিও শুরুর দিকে আতশবাজি, পটকা ব্যবহার করা হতো যুদ্ধের সময় খবর ও সংকেত পাঠানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আনন্দ-উৎসবেও বাদ যায় না নানারকম আতশবাজি, পটকা, হাওয়াই বাজি ফাটানো। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশে বিভিন্ন উৎসবে তথা বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়ায় ঈদ, শবেবরাত, শবেকদরসহ নানা ধর্মীয় উৎসবে নানা রকমের আতশবাজি ফাটানোর প্রথা একেবারে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কথা হচ্ছে, ধর্মীয় উৎসবে আতশবাজি, পটকা, চকলেট বোমা ফাটানো আদতে কতটুকু যৌক্তিক?
শব্দ ও আলোক দূষণ শুধু যে কেবল মানবদেহে প্রভাব ফেলে তা নয়, পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণী ও পক্ষীকূলের ওপরও এর প্রভাব লক্ষণীয়। তাছাড়া, শব্দবাজির জেরে প্রবীণদের মানসিক উত্তেজনাসহ রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে ঘুম নষ্ট হতে পারে। ঠিক এমনই উপসর্গ শিশুদের মধ্যেও দেখা দিতে পারে। যেহেতু পটকা বা আতশবাজির শব্দমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি থাকে। তাই, একনাগাড়ে শব্দবাজির আওয়াজে শিশুরা অস্থির হয়ে ওঠার পাশাপাশি প্যানিক ডিসঅর্ডার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাজির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে কোমলমতি শিশুদের খিদে কমে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। বাজি-পটকার অচমকা শব্দ গর্ভের ভ্রূণেরও ক্ষতি করে। গর্ভবতী মহিলারা বাজি পটকার আওয়াজে যদি হঠাৎ চমকে ওঠেন, তবে সেই ভয়ের প্রভাব তাদের জরায়ুতে পড়ে, তার ফলে গর্ভাশয়ে জলীয় পদার্থ হঠাৎ সংকুচিত হয়ে গর্ভস্থ শিশুর অপরিণত মস্তিষ্কে ব্যাঘাত ঘটায়, এর জন্য জন্ম হতে পারে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ফোর্বসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আতশবাজির কণাগুলো ধাতব লবণের সঙ্গে বিক্রিয়া করে শুধু যে ধোঁয়ার সৃষ্টি করে তা নয়, বরং গ্রিনহাউজ গ্যাস হিসেবে পরিচিত কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, নাইট্রোজেনযুক্ত গ্যাস সৃষ্টি হয় যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণও বটে। এছাড়া একটি চীনা আতশবাজিতে ৪৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ পটাশিয়াম নাইট্রেট, ২৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ সালফার, ২৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ অ্যালুমিনিয়াম ও ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বেরিয়াম নাইট্রেট ব্যবহৃত হয়। দেশে তৈরি বাজিতে ক্ষতিকর এসব উপাদান আরো বেশি থাকে। শব্দবাজির বিকট আওয়াজের ফলে সাময়িক অথবা চিরস্থায়ী শ্রবণক্ষমতা হারিয়ে যেতে পারে। শ্রবণক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি মাথা ঘোরা, মাথা ঝিমঝিম ভাবও হতে পারে। এছাড়া, কারো কানে আগে থেকে সমস্যা থাকলে আচমকা শব্দে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও লক্ষণীয়।
আসন্ন ঈদ উপলক্ষ্যে সারা দেশে আতশবাজি, পটকা ফাটানোর বন্ধে সবাই সচেতন হতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আতশবাজি, পটকার, চকলেট বোমা কেনাবেচা এবং ফাটানো রোধে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এই বাজির ভয়াবহতা রোধের আমাদের দেশেও আইন প্রণয়ন করা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আমাদের দেশের প্রশাসনকে আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন। তাহলেই, বাজির মতো নীরব ঘাতকের মোকাবিলা করতে পারব।