দেশে সবকিছুর মধ্যে কেমন যেন ছন্নছাড়া ভাব। স্বাধীনতার অর্ধশতক পরও আমরা এই ছন্নছাড়া দশা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারলাম না। কেন এমন হলো? এত ছোট্ট একটা ভূখণ্ডে ১৭ কোটি মানুষের বিপুল বিশাল জনগোষ্ঠী! দারুণ ব্যাপার হলো, আমাদের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ তরুণ। তরুণ জনগোষ্ঠী থাকার একটি বিশেষ সুবিধা আছে—জনমিতির ভাষায় এটাকে বলা হয়—ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট। এই সুবিধা বিশ্বের খুব অল্প দেশই পায়। মনে রাখতে হবে, তরুণ জনগোষ্ঠী আধিক্যের এই সুবিধা কোনো রাষ্ট্রে খুব বেশি দিন থাকে না। আমাদের গড় আয়ু এখন প্রায় ৭৩ বছর। সুতরাং কয়েক দশক পর উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও বিপুলসংখ্যক প্রবীণ জনগোষ্ঠী দেখা যাবে। অতএব তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে যা করার এখনই করতে হবে। এদের ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে এরাই হয়ে উঠবে মূল্যবান জনসম্পদ। অন্যথায় এরাই হবে অভিশাপ। অদক্ষ, অশিক্ষিত, মাদকাসক্ত, বেকার জনগোষ্ঠী একটি দেশের জন্য বোঝা। সুতরাং বিশাল এই জনসংখ্যার ডেমোগ্রাফিক্যাল সুবিধা পেতে হলে আমাদের দরকার একটি প্রশিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠী। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই প্রশিক্ষণের বিষয়গুলো শৈশব থেকেই পরিকল্পিতভাবে সম্পন্ন করতে হয়।
আমরা যদি শিশুকাল থেকে নিজেদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বিবেচনা করি—তা হচ্ছে পারিবারিক শিক্ষা। এই শিক্ষা সাধারণত পিতামাতা বা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরাই দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের রয়েছে বিপুল পরিমাণে দারিদ্র্যপীড়িত ও অশিক্ষিত পরিবার। ছিন্নমূল বাস্তুহারা পরিবারের সংখ্যাও কম নয়। এসব পরিবারের শিশুরা কী করবে? এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। সবার জন্য শিক্ষার লক্ষ্য নিয়ে রাষ্ট্র শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে বটে; কিন্তু শিক্ষাটাও তো এমন হতে হবে—যা আমাদের শিশুদের দক্ষ জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তুলবে। দক্ষ ও সচেতন জনগোষ্ঠী তৈরি হলে আমাদের সমাজের রাষ্ট্রের অনেক দায়দায়িত্ব নাগরিকের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া যায়। নগরের সবকিছু ঠিক করার দায়িত্ব তো কেবল নগরপিতা কিংবা সরকার করবে না। কোন দল কখন ক্ষমতায় ছিল, এখন যারা আছে কিংবা ভবিষ্যতে যারা থাকবে—সব ক্ষেত্রেই মনে রাখতে হবে, এই দেশটা সবার। এজন্য জনগণের সঙ্গে নগরপিতা ও রাষ্ট্রের যেন একটি বোঝাপড়া ও সমঝোতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যারা নগর ব্যবস্থাপনার কাজে রয়েছেন, তারা তো নগরবাসীর প্রতিপক্ষ নয়। নিজেদের নগরটাকে সুন্দর করে রাখার দায়িত্ব তো আমাদের ওপরেও বর্তায়। আমরা যারা নগরবাসী, তারা যদি জানি, একজন সভ্য নাগরিকের দায়িত্ব কর্তব্য কী—তাহলে অনেক সমস্যারই সমাধান অনেক সহজ হয়ে যায়। সুতরাং কী কী আমাদের নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য, সেটাও জানা থাকাটা বাঞ্ছনীয়। নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে—আমরা শহরে থাকি, আমাদের মধ্যে কতটা সিভিক সেন্স আছে? সিভিক সেন্স গড়ে তোলার জন্য শৈশব থেকে বাচ্চাদের সঠিক নর্মস শেখানোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার।
আধুনিক এই যুগে অর্থনীতিবিদরা শিক্ষাকে মানবপুঁজি হিসেবে দেখতে চান। এই পুঁজির প্রধান ভূমিকা হলো উৎপাদনে উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া। এখন উৎপাদন বৃদ্ধিতে উপকরণ (অর্থাৎ শিক্ষা) যদি ঠিকমতো কাজে না লাগে—তার কী মূল্য থাকে? সেই শিক্ষা তো অর্থনীতির জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ সুফল বয়ে আনে না। আমরা খুব সহজেই ফসলের খেতের উদাহরণ দিয়ে এটা অনুধাবন করতে পারি। প্রতিটি শিশুকে আমরা ফসলের বীজ হিসেবে কল্পনা করতে পারি। এখন এই বীজকে একটি উর্বর সমৃদ্ধ ভূমিতে রোপণ করার পর (বিদ্যালয়ে দেওয়ার পর) সেটাকে প্রতিটি ধাপে ধাপে সার দেওয়া ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ থেকে রক্ষা করা, আগাছা নির্মূল করা, পানির নিশ্চয়তা দেওয়া—এমন সব ধাপ শেষ করে তার পরই-না আমরা বাম্পার ফসল ঘরে তোলার আশা জাগাতে পারি। এসবের কোথাও ফাঁকি থাকলে—সার, পানি, কীটনাশক, আগাছা নির্মূল, প্রতিকূল পরিবেশ থেকে রক্ষা করা সম্ভব না হলে—ফসলে চিটা ধরবে কিংবা ফলন হবে অত্যন্ত খারাপ।
প্রতিটি শিশুকে শৈশব থেকে কীভাবে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, তার উদাহরণ হিসেবে অনেকে জাপানের কথা বলেন। গত বছর ফিফার ফুটবল বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ শেষে গ্যালারিতে জাপানের সমর্থকরা দারুণ একটি কাজ করেন। খেলা শেষে অন্যান্য দলের সমর্থকরা গ্যালারি ছাড়লেও, গ্যালারি ছাড়েনি জাপানের সমর্থকরা। গ্যালারিতে পড়ে থাকা আবর্জনা পরিষ্কার করতে দেখা যায় তাদের। পলিথিন, পানির বোতল ও খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ নিজেরাই পরিষ্কার করেন তারা। এর আগে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপেও অনেকগুলো ম্যাচে এমন কাজ করেছিলেন জাপানের দর্শকরা। কী করে তাদের মধ্যে এ ধরনের সচেতনতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মানসিকতা গড়ে উঠেছে? তারা পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ। তারা কেন সুইপারদের কাজ নিজেদের হাতে তুলে নেবে? তথ্য ঘেঁটে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের অর্থনীতি যখন ভঙ্গুর হয়ে পড়ে তখন জাপান সবচেয়ে জোর দেয় তাদের দক্ষ জনশক্তির ব্যাপারে। আর দক্ষ জনশক্তির জন্য প্রতিটি শিশুকে সঠিক শিক্ষায় গড়ে তোলাটাই একমাত্র উপায়। সেজন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে জাপান তাদের শিক্ষার জন্য আইন পাশ করে। বর্তমান জাপানের শিক্ষাব্যবস্থায় সেই আইনের প্রভাব অনেক। তাদের স্কুলে বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে জীবনমুখী শিক্ষা দেওয়া হয়। শেখানো হয় সামাজিকতা, ন্যায়-অন্যায়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি।
আমরা নিজেদের দিয়েও বুঝতে পারি—একটি শিশু একই সঙ্গে তার পরিবার, বিদ্যালয় ও চারপাশের পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় সচেতন করার ব্যাপারে স্থানীয় পর্যায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের ধর্মেই আছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ। পরিবেশ ও চারপাশের সৌন্দর্য আমাদের চোখে যেমন আরাম দেয়, তেমনি নোংরা পরিবেশ দৃষ্টিদূষণ ঘটনায়। সৌন্দর্যবোধও আমাদের শিক্ষা ও রুচির অংশ। এখানেও আমরা আমাদের ধর্ম থেকে শিক্ষা নিতে পারি। মহানবী (স.) জান্নাতের রূপ-সৌন্দর্য, সবুজ-সতেজ বাগ-বাগিচার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, যখন উপযুক্ত ব্যক্তি জান্নাতের দরজার কাছে যাবে, তখন মন জুড়ানো, চোখ ধাঁধানো একটি ফুল দেখতে পাবে। সেই ফুলের ঘ্রাণে বিমোহিত হবে। সে অপলক দৃষ্টিতে নীরব মনে চেয়ে থাকবে (বোখারি)। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যেমন লিখেছেন—‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি, দুটি যদি জোটে তবে অর্ধেকে ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী।’ এখন আমরা যদি সৌন্দর্যের অনুরাগী না হই, ফুল বা যে কোনো নান্দনিক কিছু ক্রয় করাটাও আমাদের কাছে অর্থের অপচয় বলে মনে হবে।
ছোটবেলা থেকে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের জন্য কী কী করতে হবে—তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যথাযথভাবে থাকতে হবে। আমাদের বাচ্চাদের জানাতে হবে কোনটা করতে হবে, কোনটা কোনোভাবেই করা যাবে না। নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের পাঠ নিতে হবে পৌরনীতি থেকে। একটি প্রজন্মকে যদি আমরা সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারি, তবে তাদের হাত ধরেই পরবর্তী প্রজন্ম একটি সুষ্ঠু, সুন্দর-নিয়মতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলবে। নতুন প্রজন্ম বুঝতে পারবে কেবল অর্থোপার্জনের জন্য নদীদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ করা যায়। কী করতে হবে আর কী করতে হবে না—ডু এবং ডু নট—এসব বিষয় স্পষ্টভাবে জানতে এবং বুঝতে না পারলে আমরা সভ্য হব কী করে? এখন সারা বিশ্বে শুরু হয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেই উন্নয়নশীল রাষ্ট্র থেকে আমাদের মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে উঠতে হবে। চাইলেও স্মার্ট জাতি হয়ে ওঠা যায় না। এজন্য আমাদের পলিসিগত বিষয়েও বিরাট পরিবর্তন আনতে হবে। আর সবকিছুর মধ্যেই থাকতে হবে আমাদের শিক্ষা, রুচি ও সৌন্দর্যের ছাপ। ঈদের ছুটিতে আমরা অনেকেই দেশের বাড়ি যাচ্ছি, ঘুরতে যাচ্ছি দেশের প্রকৃতির সৌন্দর্যের বিভিন্ন লোকেশনে। আপনি যেখানেই যান না কেন, সেখানেই আপনার শিক্ষা, রুচি ও সৌন্দর্যবোধ প্রয়োগ করুন। অনিয়ম, অনাগরিকসুলভ আচরণ দেখলে প্রতিবাদ করুন। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আপনার পাশের ব্যক্তি যদি যেখানে-সেখানে থুতু, পানের পিক কিংবা খাবারের প্লাস্টিক প্যাকেট, বোতল ফেলে দেয়, তাহলে প্রতিবাদ করুন। সাধারণ মানুষ অনুকরণপ্রিয়। কেউ সিভিক সেন্স-বর্জিত কাজ করলে অন্যরাও মনে করেন—এভাবে নোংরা আবর্জনা যেখানে-সেখানে ফেলাই যায়। কিন্তু আপনি যদি তাকে ধমকে বলেন, কেন তিনি এরকম কাজ করলেন এবং তিনি যদি ঔদ্ধত্য দেখিয়ে চলে যান (নম্র ব্যবহার, ঔদ্ধত্য না দেখানোটাও পারিবারিক ও পরিবেশগত শিক্ষার ফল), তাহলে আপনি নিজেই সেই প্লাস্টিক প্যাকেট বা বোতল রাস্তা থেকে তুলে কাছাকাছি ডাস্টবিনে ফেলতে পারেন (যেমনটা উন্নত দেশের নাগরিকরা করেন)। আপনাকে দেখে আর দশজন উদ্বুদ্ধ হবেন। আপনি একা, বিন্দু। কিন্তু বিন্দু থেকে তো সিন্ধু তৈরি হয়। ভালো কাজে ইচ্ছা, রুচি ও নিজস্ব শিক্ষাটাই যথেষ্ট। আমাদের তো ধোঁয়াটে অন্ধকার থেকে স্নিগ্ধ আলোর দিকে যেতে হবে। সেই যে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন—‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?’ সুতরাং যার যার অবস্থান থেকে আমাদের জেগে উঠতে হবে। সেই শপথ শুরু হোক এই ঈদ থেকেই। সবাইকে জানাই ঈদ মোবারক।