বেশ কিছুদিন ধরেই দেশে চালের দাম বাড়তির দিকে রয়েছে। এই দাম নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে অভিযান চালানোর পর চাল আমদানিতে শুল্ক কমিয়েছে সরকার। তবে এর প্রভাব পড়েনি বাজারে। গতকাল সোমবারও চালের দাম ছিল বাড়তির দিকে।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আমদানি শুরু না হওয়া পর্যন্ত চালের দাম কমার আশা নেই। আমদানি করা না হলে দাম আরো বাড়তে পারে। আর আমদানিকারকরা বলছেন, শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার না হলে চালের দাম কমার সম্ভাবনা নেই।
চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে আগামী চার মাসের জন্য চালের আমদানি শুল্ক কমিয়ে সম্প্রতি পরিপত্র জারি করা হয়েছে। চাল আমদানিতে সর্বমোট শুল্ক ৬২.৫ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করেছে সরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বেসরকারিভাবে কেউ চাল আমদানি করতে চাইলে আগামী ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করতে হবে। গতকাল থেকে সেই আবেদন নেওয়া শুরুও হয়েছে। তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রভাব বাজারে নেই।
গতকাল রাজধানীর বাবুবাজার, কারওয়ান বাজার, বাড্ডা, জোয়ারসাহারাসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মোটা ও মাঝারি চালের (স্বর্ণা, পাইজাম ও আটাশ) সরবরাহ তুলনামূলক কমে গেছে। এ কারণে এসব চালের দাম কেজিতে দু-তিন টাকা বেড়ে গেছে। পাশাপাশি মিনিকেট চালের দামও কেজিতে দু-এক টাকা বেড়েছে।
রাজধানীর উত্তর বাড্ডার মেসার্স পিরোজপুর রাইস এজেন্সির মালিক মো. রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বন্যার প্রভাবে বাজারে নতুন করে সব ধরনের চালের দাম বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ৮০ টাকা বেড়েছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় বন্যায় অনেক চালকল ডুবে গিয়ে মজুদ করা ধান ও চাল নষ্ট হয়েছে। মিলে বন্যার পানি ঢোকায় মিলগুলো বন্ধ রয়েছে। এ কারণে বাজারে চালের সরবরাহ কিছুটা কমে গেছে। তাই দাম বাড়ছে। আমদানি শুরু হলে আবার বাজারে চালের দাম কমে আসবে। তবে দ্রুত আমদানি শুরু না হলে বাজারে চালের দাম আরো বাড়তে পারে। ’
এদিকে গতকাল সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক বাজারদরের তথ্যেও চালের দাম বাড়তির চিত্র পাওয়া গেছে। টিসিবির তথ্য বলছে, বাজারে সরু চাল (মিনিকেট ও নাজিরশাইল) বিক্রি করা হচ্ছে কেজিপ্রতি ৬৪ থেকে ৮০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে বিক্রি করা হয় ৬৪ থেকে ৭৫ টাকায়। মাঝারি চাল (পাইজাম, লতা ও আটাশ) বিক্রি করা হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫২ থেকে ৬৪ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫২ থেকে ৬০ টাকা। মোটা চাল (স্বর্ণা, চায়না, ইরি) বিক্রি করা হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫৩ টাকায়। এই চালের দাম গত সপ্তাহে ছিল ৪৮ থেকে ৫২ টাকা।
কারওয়ান বাজারের ঢাকা রাইস এজেন্সির ব্যবসায়ী মো. সায়েম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যারা বন্যার্তদের ত্রাণ হিসেবে চাল দিচ্ছে, তারা মোটা চালই দিচ্ছে। এ কারণে বাজারে এখন মোটা চালের সরবরাহ কিছুটা কম। সরবরাহ কম থাকায় স্বর্ণা চাল, পাইজাম ও আটাশ চালের দাম বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এসব চালের দাম কেজিতে এক থেকে তিন টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মোটা চাল স্বর্ণা বিক্রি করা হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪৫ টাকায়, পাইজাম ও আটাশ চাল বিক্রি করা হচ্ছে ৫৪-৫৫ টাকায়। পাশাপাশি মিনিকেট চালের দামও কেজিতে দু-এক টাকা বেড়ে ৬৪ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নাজিরশাইল বিক্রি করা হচ্ছে প্রতি কেজি ৭৫ থেকে ৯০ টাকায়।
তবে বাবুবাজার পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নিজাম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাইকারি বাজারে চালের দাম সেভাবে বাড়েনি। আমদানি করা চাল বাজারে এলেই চালের দাম কমে আসবে। ’
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও কৃষি অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে বন্যার কারণে প্রচুর ধান ও চাল নষ্ট হয়েছে। চালকলগুলো পরিপূর্ণভাবে চালের সরবরাহ দিতে পারছে না। ফলে বাজারে সরবরাহ কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আমদানি করা চাল বাজারে না আসা পর্যন্ত দাম কমার সম্ভাবনা নেই। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে দ্রুত চাল আমদানি করার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বন্যার কারণে চালের সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম আরো বাড়তে পারে। তাই দ্রুত চাল আমদানি করে বাজারে চাল সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। ’
এদিকে চাল আমদানিকারকরা বলছেন, চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকারের কাছে শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার সেটা করেনি। শুল্ক পুরোটা প্রত্যাহার না করা হলে চালের দাম কমার তেমন সম্ভাবনা নেই।
দাম না কমার কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশে আমদানি শুল্ক কমানোর পর ভারতে চালের দাম কেজিতে দু-তিন টাকা করে বেড়েছে।
নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরন সাহা চন্দন বলেন, ‘এখনো ২৫ শতাংশ শুল্ক রয়ে গেছে। আমরা চেয়েছিলাম অবাধ আমদানি সুবিধা। কিন্তু সরকার এখনো তা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। আমদানি সুবিধা অবাধ থাকলে আমদানিকারকরা তাঁদের সুবিধামতো যেকোনো দেশ থেকে চাল আমদানি করতে পারতেন। ’
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, ‘স্থানীয় বাজারে আমদানি শুল্ক কমানোর প্রভাব আসতে কিছুটা সময় লাগবে, কারণ আমদানিকারকরা এখনো ভারত থেকে আমদানি করার প্রক্রিয়া শুরু করেনি। ’
নওগাঁয় চালের বাজার স্থিতিশীল
এদিকে দেশের অন্যতম বড় চালের মোকাম নওগাঁয় চালের বাজারে দাম স্থিতিশীল রয়েছে। কিছুদিন আগে অভিযানের সময় নওগাঁর খুচরা বাজারে চালের দাম কেজিতে দু-এক টাকা কমেছিল। তা এখন ওই অবস্থায় রয়ে গেছে।
নওগাঁ পৌর খুচরা চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক উত্তম সরকার জানান, সম্পাকাটারি চাল প্রকারভেদে কেজিতে ৭৩ থেকে ৭৫ টাকা, হাতছাটি ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, জিরাশাইল (মিনিকেট) ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি করছেন তাঁরা। আর পাইকারি বাজারে সম্পাকাটারি (নাজির) প্রতি কেজি প্রকারভেদে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা, সম্পাকাটারি (দুই সিদ্ধ) ৬৩ থেকে ৬৫ টাকা, জিরাশাইল ৫৯ থেকে ৬২ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
কৃষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কৃষকের কাছে এখন আর ধান নেই। তাই চাল আমদানি করা হলেও কৃষকের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই।
নওগাঁর মহাদেড়বপুর উপজেলার ভীমপুর ইউনিয়নের খোর্দ্দনারায়ণপুর গ্রামের কৃষক আবুল কালাম বলেন, ‘আমি ইরি বোরো মৌসুমে পাঁচ বিঘা জমিতে জিরাশাইল ধান চাষ করেছিলাম। সব ধান বিক্রি করে দিয়েছি। ’
একই গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘আমি ২২৫ মণ ধান পেয়েছিলাম। দোকানির পাওনা মেটাতে এবং সংসারের খরচ চালাতে এরই মধ্যে ২০০ মণ ধান বিক্রি করেছি। যে ২৫ মণ ধান বাড়িতে রয়েছে, সেগুলো খাবারের জন্য রাখা হয়েছে। ’
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ শামছুল ওয়াদুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, কৃষকের কাছে এখনো কিছু ধান রয়ে গেছে। এ ছাড়া পরিবারে প্রয়োজনেও কিছু ধান কৃষক বাড়িতে রাখেন। তাই এখন চাল আমদানি করা হলেও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।