নড়াইলে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কলেজ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনায় দেখা দিয়েছে উত্তেজনা; চলছে প্রতিবাদ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গতকাল সোমবার এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে শান্তিসভা করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসার ইমাম এবং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, রাজনৈতিক নেতা ও বিশিষ্টজনকে নিয়ে এই সভা হয়।
এদিকে, শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদ জানিয়ে এতে জড়িতদের বিচারের দাবি জানিয়েছে ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ’। গতকাল রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আয়োজিত সমাবেশে এ দাবি জানানো হয়। শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনায় নড়াইলের জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচার দাবি করা হয় সমাবেশ থেকে। এই শিক্ষককে
হেনস্তার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস)। এক বিবৃতিতে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. নুর মোহাম্মদ তালুকদার ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
স্বপন কুমারকে হেনস্তা করার ঘটনা তদন্তে কমিটি করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। ওই ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে সোমবার এ কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়।
নড়াইলের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়, নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক রবিউল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবাস চন্দ্র বোস, পৌর মেয়র আনজুমান আরা, মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট অচীন চক্রবর্তী প্রমুখ।
মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায় ফেসবুকে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে অবমাননাকর পোস্ট দেওয়ায় গত ১৮ জুন কলেজে উত্তেজনা দেখা দেয়। এ সময় বিক্ষুব্ধ লোকজন শিক্ষকদের তিনটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয় এবং ওই ছাত্র ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়। এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে
পড়লে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক বলেন, ঘটনাটি তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জুবায়ের হোসেন চৌধুরী এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিয়াজুল ইসলামের নেতৃত্বে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের কলেজ ও প্রশাসন উইংয়ের পরিচালক শাহেদুল খবির চৌধুরী জানান, আমরা ওই অঞ্চলের পরিচালককে বলেছি বিষয়টি দেখতে।
এ বিষয়ে খুলনা বিভাগীয় উপপরিচালক (মাউশি) এ এস এম আবদুল খালেক বলেন, মাউশি থেকে মৌখিকভাবে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সোমবারই নড়াইল জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে মঙ্গলবারই প্রতিবেদন মাউশিতে পাঠানো হবে।
এদিকে জাতীয় জাদুঘরের সামনে সমাবেশে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক ড. আব্দুর রাজ্জাক খান, বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদের নেতা কাজল দাশ, নাগরিক আন্দোলনের নেতা শরিফুল ইসলাম শরিফ, বাংলাদেশ শিক্ষক ঐক্য পরিষদের নেতা রণজিৎ দেব, মাইনরিটি রাইটস ফোরামের নেতা
অমূল্য কুমার বৌদ্ধ প্রমুখ। মানববন্ধনে মূল বিষয় উপস্থাপন করেন নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ-এর সংগঠক লেখক ও গবেষক রবীন আহসান। মানববন্ধনে মাইনরিটি রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ শিক্ষক ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (বাকবিশিস) নেতাকর্মীরা সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষক স্বপনকে হেনস্তার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গতকাল সকালে ‘আমিও স্বপন কুমার বিশ্বাস’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে অবস্থান নেন দু’জন। তাঁরা হলেন- ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক গোলাম হোসেন হাবীব ও স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল হক। শিক্ষক হাবীব বলেন, শিক্ষকদের ওপর হামলা ও হেনস্তার ঘটনা বাড়ছে। এ নিয়ে মানুষ কথা বলছে না। শিক্ষক অবমাননা ন্যক্কারজনক। এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় এক বিবৃতিতে উদ্বেগ জানিয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক পৃথক বিবৃতিতে শিক্ষক নিপীড়নের ঘটনায় ক্ষোভ, নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।