শনিবার দুপুরে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের হাসপাতালে ভর্তির খবরটি প্রথম পাই। ১৭ এপ্রিল রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। এই হাসপাতাল দেশপ্রেমিক মানুষের অল্প টাকায়, কোনো কোনো সময় বিনা পয়সায় চিকিৎসা নেওয়ার অন্যতম আশ্রয়স্থল। পঙ্কজ দার ঘনিষ্ঠজন কাজল দেবনাথ দাদার বার্তা থেকে আরো জানতে পারলাম, তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। সেদিন ডা. সামন্ত লাল সেন দেখে যাওয়ার পর বলে গেছেন, পঙ্কজ ভট্টাচার্য শঙ্কামুক্ত নন।
প্রথমে ভেবেছিলাম, যে হাসপাতালে তিনি ভর্তি আছেন, কর্তৃপক্ষের আগ্রহ, দায়িত্ব আর ভালোবাসার জায়গা থেকে তিনি সর্বোচ্চ চিকিৎসা পেয়ে ফের হাসবেন। আবারও মাইকের সামনে দাঁড়াবেন। শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলবেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা। মনোযোগ দিয়ে আমরা তার কথা শুনব। পরদিন পত্রিকার পাতায় লিখব। দাদা আবারও বলবেন…।
যখনই দেখলাম তিনি লাইফ সাপোর্টে, তখনই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বুকের ভেতরটা বারবার দুরুদুরু করছিল। এই বুঝি খারাপ সংবাদ এলো। সংবাদকর্মী হিসেবে মন না চাইলেও তো সংবাদ এড়িয়ে যাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত ভয়ংকর দুঃসংবাদটি পেলাম।
মৃত্যু অনিবার্য। কারো সাধ্য নেই তাকে ফেরানোর। শত প্রার্থনা, ভালোবাসা যেমন পঙ্কজদাকে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া থেকে আটকাতে পারেনি। তার চলে যাওয়া সমাজের জন্য বড় রকমের ক্ষতির কারণ। হয়তো আরেক জন প্রতিবাদী, দেশপ্রেমিক, মুক্তবুদ্ধি চর্চায় বিশ্বাসী মানুষ আমরা পাব। কিন্তু যাকে হারালাম, তার শূন্যস্থান অন্যজন কতটুকু পূরণ করতে পারবেন সেটাই বড় কথা।
সমাজের জন্য পঙ্কজ ভট্টাচার্যের এত বেশি কেন প্রয়োজন? বড় কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম তিনি না পেলেও সঠিক কথাটুকু সময়মতো বলতেন। নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে থাকতেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন। উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাহসী উচ্চারণ ছিল তার। তেমনি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। ঘটনাস্থলে যেতেন। প্রকাশ্যে হামলাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরে বক্তব্য দিতেন। নির্ভয়ে সত্য বলার মানুষ যখন কমছে, তখন পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে আমরা হারালাম।
গত ২০ বছরে দেশের রাজনীতিতে ও সমাজে একটা বিরাট রকম পরিবর্তন এসেছে। তা হলো সমাজের একটা শ্রেণির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা বিরাটভাবে স্থান করে নিয়েছে, যা অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে হওয়ার কথা ছিল না। তেমনি সন্ত্রাস, উগ্রবাদ, ধর্মান্ধতা সবকিছুর সূচক ঊর্ধমুখী। বারবার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সংস্কৃতি আক্রান্ত হচ্ছে। গত ১৫ বছর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ও এ ধরনের অঘটন বন্ধ হয়নি। একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার জায়গায় আওয়ামী লীগ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যা হয়েছে তা শুধু কাগজে-কলমে আর সভা-সমাবেশের বক্তব্যে। ভেতরে ভেতরে মৌলবাদীরা তাদের উদ্দেশ্য সফল করেছে। করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও হয়তো করবে।
এই পরিবেশে যারা উগ্রবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাদের একজন ছিলেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য। নানা কারণে তিনি রাজনীতির মাঠে সুবিধাজনক কোনো অবস্থান তৈরি করতে পারেননি। কিন্তু দেশপ্রেম থেকে বিচ্যুত হননি। সংকট, সংগ্রামে সামনের সারিতে ছিলেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা। সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। বিরোধী দলসহ রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনাও করেছেন নির্দ্বিধায়। প্রয়োজনে সরকারেরও সমালোচনা করেছেন অবলীলায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষদের একত্রিত করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। ছুটে গেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তার কাছে পুরো দেশটাই নিজের বাড়ি মনে হতো। ঘরের মানুষের মতো সবাইকে ভালোবাসতেন, আপন ভেবে কথা বলতেন। একজন প্রকৃত রাজনীতিবিদের যেমন হওয়া উচিত, তিনি ঠিক তেমনই ছিলেন।
সর্বোপরি পরিচ্ছন্ন রাজনীতি ও সমাজ প্রতিষ্ঠা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শুভ, মঙ্গলের পক্ষে ছিলেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য। সমাজকে অকাতরে দিয়ে গেছেন তিনি। অর্থাৎ আলো ছড়াতে কোনো অবস্থাতেই কার্পণ্য করেননি এই রাজনীতিক।
সদ্য বিদায়ি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের গতকালের একটি বক্তব্য খুব বেশি মনে পড়ছে। বিদায় বেলায় সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় দেশের মানুষকে ভালোবেসে রাজনীতি করতে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদদের দেশের মানুষকে ভালোবেসে রাজনীতি করা উচিত। তাহলেই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে।’ সমাজের প্রতিটি স্তরে রাজনৈতিক নেতাদের মানুষকে সত্যিকারের ভালোবাসার অভাব উপলব্ধি করেছেন মাটি ও মানুষের নেতা আবদুল হামিদ। তাই বঙ্গভবন থেকে বিদায় বেলায় অন্তরের কথাটি বলে গেছেন তিনি।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৯ সালে চট্টগামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামে। এখানেই জন্মেছিলেন আরেক সূর্যসন্তান, যিনি মাস্টারদা সূর্যসেন হিসেবেই সবার পরিচিত। পঙ্কজদাও মাত্র ১৫ বছর বয়সে ছাত্র থাকাকালে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং তখন থেকেই নিবিড়ভাবে, একনিষ্ঠ চিত্তে রাজনীতির জন্য ত্যাগ করে গেছেন। বয়সের ভারে ন্যুইয়ে পড়া পঙ্কজ ভট্টাচার্যের স্ত্রীকেও করোনায় কেড়ে নিয়েছে। সে সময় তিনি আরো দুর্বল হয়ে পড়েন। এক নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকতেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও মাটি আর মানুষের প্রেম থেকে নিজেকে আড়াল করেননি অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর হিসেবে পরিচিত তার নাম। পঙ্কজ ভট্টাচার্য, আপনার বিদায়ে আমাদের আশ্রয় আর অভিযোগ জানানোর জায়গা কমে গেল।