পুলিশ সদস্য আব্দুল মোমিন। ঈদগাহ ময়দানে ঈদের জামাতকেন্দ্রিক সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন যেন কারো নিরাপত্তায় হুমকি না আসে। সকাল ৭টা থেকেই তার ডিউটি। ঈদের দিন বলে একটু আয়েশ করে ঘুমানোরও কোনো সুযোগ নেই! ভোরে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে নিত্যদিনের পোশাক (ইউনিফরম) পরেই তৈরি হতে হয়েছে ঈদগাহে আসার জন্য। তবে নামাজ পড়তে নয়। সবাই যখন নামাজ পড়েন, তখন অস্ত্র হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন আব্দুল মোমিন। আর সবার মতো তারও স্বজনের জন্য মায়া আছে, আছে কাছে যাওয়ার আকুতি, আছে একসঙ্গে বসে উৎসবের খাবার খাওয়ার বাসনা। কিন্তু কী আর করা, পেশাটাই এমন যে, এখানে আবেগের কোনো স্থান নেই!
পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) কাজ করেন বেলাল হোসেন। ঈদের দিন দায়িত্ব পড়েছে ঈদগাহ ময়দানে। সাদা পোশাকে নিবিড় নজরদারির দায়িত্ব পালন করছেন। বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান আছেন গ্রামের বাড়িতে। অভিমানী সন্তানকে কীভাবে মানাবেন, তা জানেন না তিনি।
উৎসব ঘিরে এ রকম একেকটি গল্প রচিত হয় লাখ লাখ (প্রায় ২ লাখ ১২ হাজার ৭২৪ জন) পুলিশ সদস্যের জীবনে। যারা অন্যের ঈদ নির্বিঘ্ন করতে কাজ করে যান নিরলসভাবে। কেউ সড়ক, নৌ ও রেলপথে, কেউ ঈদগাহ-মসজিদে, কেউ মার্কেট-শপিংমলে, কেউ গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও স্থাপনায়, কেউ অপরাধী ধরতে কিংবা অপরাধ ঠেকাতে দায়িত্ব পালন করেন। মূলত মানুষের নিরাপত্তা দেওয়াটাই তাদের কাছে মুখ্য বিষয়। আর নিজের ও পরিবারের আনন্দ নিতান্তই গৌণ! তখনই ভালো লাগে, যখন তাদের কাজে জনগণ সন্তুষ্ট হন। তখনই নিজেকে সার্থক মনে হয়। চাকরি জীবনের শুরুতে পারিবারিক পরিবেশের জন্য হয়তো মন খারাপ হয়, কিন্তু পরে ধীরে ধীরে সব সয়ে যায়।
সারা দেশ যখন উৎসবমুখর ঈদের আনন্দে ভাসে, পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে ছোটে নাড়ির টানে; ঠিক সেই সময়ে মান্যবর আইজিপি (ইনপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ) মহোদয়ের নির্দেশনায় দিনরাত ব্যস্ত থাকেন বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি ইউনিটের সদস্যরা। নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে নিরলস কাজ করে যান ঘরমুখী সাধারণ মানুষের যাতায়াত নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করার প্রয়াসে। সবাই যখন ঈদ আনন্দে ব্যাকুল থাকেন, চারদিকে কেনাকাটার ধুম, আপনজনের কাছে ফেরার প্রাণান্ত চেষ্টা; একই সময়ে তাদের আনন্দকে নির্বিঘ্ন করতে নিজেদের পরিবার-পরিজনকে দূরে রেখে সহাস্য বদনে সেবা প্রদানে সচেষ্ট থাকেন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা।
শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, প্রগতির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত বাংলাদেশ পুলিশের সেবাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ যোদ্ধা এবং করোনাকালীন সম্মুখযোদ্ধা বাংলাদেশ পুলিশের অকুতোভয় সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার সতর্ক দৃষ্টি আর আন্তরিক প্রচেষ্টাতেই জনসাধারণের স্বাভাবিক এবং নিরাপদ জীবনযাপন সম্ভব। আর এ কারণেই সবার মতো ঈদ পার্বণ আসে না পুলিশের জীবনে।
‘Bangladesh Police is committed to enforce law, maintain social order, reduce fear of crime, enhance public safety and ensure internal security with the active support of the community’—এই মিশনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ পুলিশের সব ইউনিট একযোগে মান্যবর পুলিশ প্রধানের নির্দেশনায় ইউনিফরমে এবং সাদা পোশাকে সুচারুরূপে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সড়ক ও মহাসড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পুলিশ; বাস স্টেশন, রেল স্টেশন ও নৌ বন্দরে পাহারারত পুলিশ; বাসস্থান, শপিংমল, মার্কেট, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, টুরিস্ট স্পটের নিরাপত্তায় পুলিশ; চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা, অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি, জালটাকা, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ সংঘবদ্ধ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ; গার্মেন্টস, শিল্পকারখানার মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে বেতন বোনাসের সমন্বয় সাধনে পুলিশ; বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিঘ্নকারী তথ্য, গুজব, পোস্ট, মন্তব্যের আলোকে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশ; জঙ্গি, সন্ত্রাসী, নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড রোধে পুলিশ; রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ, স্থাপনা, আদালত প্রাঙ্গণ, গার্ড/কেপিআই নিরাপত্তায় পুলিশ; বড় ধরনের আর্থিক লেনদেন, অর্থ পরিবহন, রাষ্ট্রীয় আয়োজনের নিরাপত্তায় পুলিশ। সব জায়গায় সব কাজে পুলিশই থাকেন অগ্রসেনার ভূমিকায়।
বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা ২৪ ঘণ্টাই মাঠে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। কারণ, পুলিশ আইন, ১৮৬১ (১৮৬১ সালের ৫ নম্বর আইন)-এর ২২ ধারায় উল্লেখ আছে, ‘এই আইনের উদ্দেশ্যে প্রত্যেক পুলিশ কর্মচারী সর্বদা কার্যে রত (on duty) বলিয়া বিবেচিত হইবে এবং যে কোনো সময় জেলার যে কোনো স্থানে তাহাকে পুলিশ অফিসার হিসেবে নিযুক্ত করা যাইবে।’ কিন্তু, কখনো কি অনুভব হয়েছে যে, নীলাভ পোশাকের আড়ালেও রয়েছে একটি রক্তমাংসে গড়া শরীর। সেখানে সাধারণ মানুষের মতোই রক্তের ধারা প্রবাহিত হয়। সে রক্তেও আবেগ আছে, ভালোবাসা আছে, আছে সীমাহীন দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার। জীবনের সোনালি দিনগুলো এভাবেই চলে যায়। পুলিশ ভুলে যায় প্রিয়জনদের ঘিরে বিভিন্ন উৎসবমুখর দিনগুলোর কথা। একগুচ্ছ মান-অভিমান সামলে প্রতিশ্রুতি দেন পরবর্তী উৎসবে বাবা, মা, ভাই-বোন, স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে তাদের আয়োজনে শামিল হবেন।
মানুষের নিরাপত্তাই মূলত তাদের কাছে আনন্দের এবং ইবাদতস্বরূপ। সবাই যখন ঈদের জামাতে, পাশেই দাঁড়িয়ে তারা সতর্ক অবস্থায়। সবাই যখন ঈদের আনন্দে মত্ত, তখন তারা মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার কাজে ব্যস্ত। ঈদের নতুন পাঞ্জাবি কিংবা জামাটাও হয়তো রয়ে গেছে ব্যারাকের সেই লকারে কিংবা ট্রাঙ্কেই। সেদিকে তাকানোর ফুরসত কোথায়? জনগণের নিরাপত্তাই সবার আগে।
প্রতিবারের মতোই এবারও সেই একই লক্ষ্য নিয়ে ঈদের দিনগুলোতে কাজ করেছেন বাংলাদেশ পুলিশের মানবিক সদস্যরা। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে কিংবা পরিবার-পরিজনের স্নেহ-মমতা আর ভালোবাসাবঞ্চিত পুলিশ সদস্যরা ঈদ আনন্দ উপভোগ করেছেন সাধারণ মানুষের ঈদ আনন্দের মধ্যেই। পুলিশ সদস্যদের কাছে দায়িত্বই সবার আগে। এ পথচলাতেই তাদের আনন্দ।