বর্তমান বিশ্বের আলোচিত-সমালোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। অবশ্য ইসরায়েল-ফিলিস্তিনসহ আরব বিশ্বের যুদ্ধবিগ্রহও ব্যাপক আলোচিত। পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের কথাও বাদ দেওয়ার মতো নয়। অন্য দিকে বিশ্বের সংকটময় বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জলবায়ু যুদ্ধ। মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধগুলোর সমাধান দ্রুত না ঘটলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হয়তো-বা দীর্ঘায়িত নাও হতে পারে। কিন্তু জলবায়ু যুদ্ধ চলমান থেকেই যাবে। যুগের পর যুগ ধরে এই যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটবে, যদি শিল্পোন্নত দেশগুলো সদয় না হয়, অথবা বিশ্ব মোড়লেরা যদি জাগ্রত না হন। কারণ দীর্ঘমেয়াদি এই যুদ্ধ সভা-সেমিনার বা সম্মেলনের মাধ্যমে অবসান হওয়ার নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে শিল্পবিপ্লবের প্রসার, তথা শিল্পোন্নত দেশের বৃহত্তর স্বার্থও। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তন রোধের আন্তরিক প্রচেষ্টা শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে ব্যাপক আশা করা বোকামির শামিল। সত্যি বলতে শিল্পোন্নত দেশগুলো শুধু সম্মেলন আর অনুদান দিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করছে; বিষয়টি অনুধাবন করেছেনও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই তিনি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি দাবি রেখেছেন, অনুদান নয়; কার্বন নিঃসারণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার। পাশাপাশি শিল্পোন্নত দেশগুলোকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে বেশি মনোযোগী হতে পরামর্শ দিয়ে আসছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ২০২১ সালে দুই দিনব্যাপী ‘লিডার্স সামিট’-এর উদ্বোধনী সেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একথা ব্যক্ত করেছেন। এছাড়াও সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বনেতাদের প্রতি আরো কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। পরামর্শগুলো যথাক্রমে, কার্বন নিঃসারণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা, জলবায়ুর ক্ষতি প্রশমন এবং পুনর্বাসনে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার ফান্ড নিশ্চিত করা।
‘লিডার্স সামিট’-এ দেওয়া পরামর্শ ছাড়াও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে জোরালো দাবি তুলে আসছে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ নামের ফান্ড গঠনের জন্য। কারণ বাংলাদেশের সম্পদ সীমাবদ্ধতা থাকার পরেও বছর বছর জলবায়ু অভিযোজন এবং টেকসই অবকাঠামো নির্মাণে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে আসছে, যা বাংলাদেশের জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ। এই ফান্ড গঠনের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তরা বা উদ্বাস্তুরা ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবেন। দেরিতে হলেও ২০২২ সালে মিশরে অনুষ্ঠিত কপ-২৭ জলবায়ু সম্মেলনে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল গঠনে ঐকমত্য পোষণ করেছে বিশ্বের ১৯৮টি দেশ, যা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিগ্রস্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য সুখবরই বটে।
জোর দিয়ে আমরা একটি কথা বলতে পারি যে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ মোটেও দায়ী নয়। অথচ একটি গ্রাউন্ড-জিরো দেশ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে। যার ফলে দেশটি ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, বন্যা, তাপপ্রবাহ, খরা, বজ্রপাত ও নদীভাঙনের মতো ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছে বারবার। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে দ্রুত। তারই সঙ্গে নোনাজল প্রবেশ করে কৃষিজ সম্পদ এবং খাবার জলের সংকট তৈরি করছে। ভিটেমাটি হারিয়ে মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে গাছগাছালির আগা মরে যাচ্ছে দ্রুত এবং বন্যপ্রাণীদের জীবনযাত্রা ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। এই বিষয়গুলো বহির্বিশ্বের মানুষের ইতিপূর্বে তেমনভাবে জানা ছিল না। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে এই দেশের মানুষের টিকে থাকার সংগ্রাম বহির্বিশ্বের মানুষকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাপকভাবে অবহিত করেছেন। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলো দক্ষভাবে মোকাবিলা করার সুদূরপ্রসারি কর্মকৌশলও শেখ হাসিনার কল্যাণে বিশ্ববাসী জেনেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত ৫০টি স্বল্পোন্নত দেশ, যারা গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসারণের জন্য মোটেও দায়ী নয়, তাদের মুখপাত্র হয়ে তিনি দায়িত্ব পালন করে পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’—২০১৫ ভূষিত হয়েছিলেন। যে গৌরব শুধু তার একারই নয়, এটি সমগ্র দেশবাসীরও গৌরব। সুতরাং আমাদের উচিত জলবায়ু যুদ্ধের এই সারথির পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করা। বিশেষ করে যুব সম্প্রদায় ও শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসতে হবে জলবায়ু যুদ্ধে শামিল হতে। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা সার্থক হবে এবং দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বহির্বিশ্বের কাছেও।
শিক্ষার্থীদের বিষয়ে আমরা একটি কথা না বলে পারছি না। আমরা দেখেছি উন্নতবিশ্বের শিক্ষার্থীরা যখন জলবায়ু পরিবর্তন রোধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন, সেই সময় আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে সময় কাটাচ্ছেন। বিষয়টা দুঃখজনকই বটে! বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের অনেকেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টা এখনো পরিষ্কারভাবে বুঝতে সক্ষম হননি। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, অনেক উচ্চ শিক্ষিতরাও বিষয়টা বুঝলেও বোঝাতে সক্ষম নন। এসব কিন্তু তাদের অজ্ঞতার কারণেই ঘটছে। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপকভাবে তুলে ধরতে হবে। শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেই তবে বনায়ন সৃষ্টিতে আগ্রহ বেড়ে যাবে এবং বৃক্ষ নিধন ও পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে। শুধু পাঠ্যপুস্তকই নয়, এ দায়িত্ব নিতে হবে প্রচার মাধ্যমগুলোকেও, নিতে হবে সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরও। এছাড়াও সমাজের তারকা ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কাজ করতে।
আমরা লক্ষ করছি, আমাদের দেশের তারকা শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ পরিবেশ কিংবা জলবায়ুসংক্রান্ত বিষয়ে খুব একটা কথা বলতে দেখা যায় না। তারকাদের ভূমিকা এ বিষয়ে জিরো পার্সেন্ট লক্ষ করা যায়। অথচ তারা সভা-সেমিনার করে দেশবাসীকে সচেতন করতে পারতেন; কিন্তু তা তারা করছেন না। কেন করছেন না, সেটা অবশ্য বোধগম্য নয়; প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাচ্ছে বিষয়টা। তথাপিও আমাদের প্রত্যাশা তারকারা পরিবেশ রক্ষায় সোচ্চার হবেন, দেশবাসীকে সচেতন করবেন, সামাজিক বনায়ন সৃষ্টিতে অবদান রাখবেন। তবেই তাদের তারকাখ্যাতি সার্থক হবে। এভাবে স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে প্রত্যেকেই সোচ্চার হলে সবুজ বিশ্ব তথা বাংলাদেশকে বাঁচানো সম্ভব হবে।