দিনভর বৈঠকে ঋণের নানা শর্ত পরিপালনের অগ্রগতি দাতা সংস্থা আইএমএফকে জানাল বাংলাদেশ ব্যাংক। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন আইএমএফ প্রতিনিধিরা। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে একটি বৈঠকে অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও। বিকালে বৈঠক নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন মুখপাত্র মেজবাউল হক।
মেজবাউল হক সাংবাদিকদের জানান, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ে একক হারের দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আসছে বাজেট ও মুদ্রানীতিতে আর্থিক খাত সংস্কারের নানা ঘোষণা থাকবে বলেও জানান বাংলাদেশ ব্যাংক মুখপাত্র।
ব্রিফিংয়ে মেজবাউল হক আরো জানান, শিগিগরই মোট ও নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ শুরু হবে। রিজার্ভ বাড়াতে রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক ঋণ বাড়ানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনসহ নানা উদ্যোগের কথাও আইএমএফ প্রতিনিধিদের জানানো হয় বৈঠকে। এ বৈঠকে অংশ নেন সংস্থাটির আট সদস্য।
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের হালনাগাদ অবস্থা জানার সঙ্গে আর্থিক খাতের নীতি ও কাঠামো সংস্কারের মধ্যে চলা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে; তা জানার পাশাপাশি সমাধানের পরিকল্পনা জেনে নিচ্ছে আইএমএফ। প্রতিনিধিদলের সফরটি চলবে আগামী ৭ মে পর্যন্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংকে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে শুরু করে দিনভর খণ্ড খণ্ড বৈঠক করে ঢাকা সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর প্রতিনিধিদল। ঐ সব বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, আবু ফরহা মো. নাছের ও বিভিন্ন বিভাগের নির্বাহী পরিচালক, পরিচালক এবং টিম সদস্যরা অংশ নেন।
বৈঠকে আর্থিক খাতের নীতি ও কাঠামো সংস্কারের যে সব উদ্যোগ গত জুলাই থেকে নেওয়া হচ্ছে তার বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও ফলাফল তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব বৈঠকে।
বিশেষ করে ব্যাংকের পরিদর্শন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে ঝুঁকিভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা, ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা আনা ইত্যাদি। আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়ার পর বেশ কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ এবং কিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জ্বালানি তেল থেকে ভর্তুকি তুলে দিয়ে মূল্য বৃদ্ধি করা। ২য় দফায় জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়ে সে বিষয়ে পৃথকভাবে জানতে চেয়েছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল।
এবারের সফরের আলোচিত বিষয়ে সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে মুদ্রানীতিতে নেওয়া বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়, বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিনিময় হার কেমন, মূল্যস্ফীতি কেমন; তার পর্যালোচনা ও এচিভমেন্ট (অর্জন) নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
অর্থনীতিতে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে ও এটিকে এড্রেস (সমাধানে) করতে কী পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে তার ধারণা নিয়েছেন আইএমএফ প্রতিনিধিদল।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপের মুখে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে আইএমএফের ঋণের আবেদন করে বাংলাদেশ গত বছর। ফেব্রুয়ারিতে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার পাওয়ার আগে ও পরে বাংলাদেশ পরামর্শ অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানোসহ আর্থিক খাতের কাঠামো ও নীতি সংস্কারে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে। সংস্থাটির কাছ থেকে ঋণ নিতে চুক্তির সময় বাংলাদেশ এসব বিষয়ে সংস্কারের বিষয়ে সম্মতি দিয়েছিল।
আগামী অক্টোবর মাসে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় ও অগ্রগতি মূল্যায়নের জন্য আইএমএফ মিশন আসবে ঢাকায়। তার আগে নিয়মিত সফরের অংশ হিসেবে স্টাফ ভিজিটে এসেছে সংস্থার প্রতিনিধি।
নিয়মিত এ সফরের তথ্য নেওয়ার পাশাপাশি ঋণের অর্থ ব্যবহার ও পরিশোধে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সংশ্লিষ্ট সূচকের মধ্যে প্রকৃত রিজার্ভ, রেমিট্যান্স প্রবাহ, সুদহার, বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতি অবস্থান, সরকারের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি ও ব্যাংক ঋণ, বাণিজ্য ও চলতি হিসাবের ঘাটতি ইত্যাদি তথ্যের হালনাগাদ তথ্য জেনে নিচ্ছে আইএমএফ।
আলোচনার সূচিতে প্রাধান্য পেয়েছে আর্থিক খাতের সংস্কার, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন ও আইনি ক্ষমতার ব্যবহার, নতুন নীতি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ।
১ম কিস্তির ঋণের অর্থের ব্যবহার ও ২য় ঋণের প্রাপ্তি নিয়ে এবারের সফরের সম্পর্ক বিষয়ে মেজবাউল হক বলেন, তারা সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের অগ্রগতি নিয়ে খোঁজখবর নিয়েছে। রিজার্ভ, জিডিপি, মূল্যস্ফীতি, বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতি ও অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা নিয়ে সার্বিক আলোচনা হচ্ছে। শুধু ঋণকে আলাদা করে কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা সামষ্টিক অর্থনীতির সব সূচক নিয়েই আলোচনা করছি। যার মধ্যে সবকিছু আছে।
পরবর্তী কিস্তি পেতে আইএমএফের সংস্কার প্রস্তাবের ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, আমাদের নিজস্ব প্রয়োজনে কিছু রিফরম (সংস্কার) নিয়ে কাজ করছি। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার একাধিক রেট একটিতে নিয়ে আসা, সুদহার বাজারমুখী করা ও রিজার্ভ হিসাব আইএমএফের বিপিএম ছয় পদ্ধতিতে করার বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। রিজার্ভ হিসাবে আমাদের গ্রস হিসাবটিও থাকবে। যে সব সিদ্ধান্তের কথা আমরা জানিয়েছি তার বিস্তারিত বর্ণনা ও বাস্তবায়ন কীভাবে হবে—তা জুলাই মাসের আগামী মুদ্রানীতিতে ঘোষণা থাকবে, বলেন তিনি।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আইনে সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত থাকার কথাও জানান মেজবাউল হক।
আইএমএফের বিপিএম ছয় পদ্ধতিতে রিজার্ভ হিসাব করলে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ঝুঁকি দেখছে না জানিয়ে মেজবাউল হক বলেন, এখনো আমরা রিজার্ভ নিয়ে কোনো ঝুঁকিতে নেই। সামনে বিশ্বব্যাংক, জাইকাসহ কয়েকটি সংস্থার ঋণ নিয়ে আলোচনা পাইপলাইনে রয়েছে। আকু পেমেন্ট ছাড়া আগামী জুনের মধ্যে আমাদের বড় কোনো দায় নেই। তাই এখনো কোনো সমস্যা দেখছি না।
চাপে থাকা রিজার্ভ স্বস্তিদায়কে ফেরাতে আমদানিতে যে কড়াকড়ি করা হয়েছে—তা আগামীতেও অব্যাহত রাখা হবে কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে মেজবাউল হক বলেন, আমরা আমদানিতে মার্জিন বাড়িয়েছি অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে। কোনো পণ্য আমদানিতে নিরুত্সাহিত করতে মার্জিন বাড়ানো হয়। আবার কমানো হয়। সবই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অংশ। যখন যেটা প্রয়োজন হয় বাংলাদেশ ব্যাংক নিচ্ছে। এবারও সংস্থাটির বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব অধিদপ্তর (এনবিআর) ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করবে আইএমএফ প্রতিনিধিদল।