কক্সবাজারে মাছ ধরার ট্রলার থেকে উদ্ধার করা নিহত ১০ জেলের নাম নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। ছয় জনের পুরো পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে সোমবার। বাকি চারটি লাশ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় পুরো পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ টেস্টের প্রয়োজন হবে।
নিহতদের পরিবারের সদস্যরা ঘটনাটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড বলে অভিযোগ করেছেন। তারা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ট্রলারের মালিক শামসুল আলম ওরফে শামসু মাঝির প্রতিপক্ষ গ্রুপ এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শামসুল আলম নিজেও নিহত হয়েছেন।
কক্সবাজার শহরের উপকূলবর্তী বাঁকখালী নদীর মোহনার নাজিরারটেক পয়েন্ট থেকে রোববার বিকেল তিনটার দিকে একটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহগুলো অর্ধগলিত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, শামসুল আলমসহ মোট ১৯ জন ৭ এপ্রিল সাগরে যান মাছ ধরতে। ৯ এপ্রিল তাদের ট্রলারে প্রতিপক্ষ গ্রুপ হানা দেয়। ছয় জন সেখান থেকে রক্ষা পেলেও ১৩ জন নিখোঁজ হন। এখনও তিনজন নিখোঁজ। যে ছয়জন ফিরে এসেছেন তাদের পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে।
পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার আগে ফিরে আসাদের একজন মো. হায়াত স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, ‘গভীর সাগরে ৯ এপ্রিল ফিশিং ট্রলারে ডাকাতি করার অভিযোগে মাতারবাড়ি এলাকার বাইট্টা কামাল, একই এলাকার নুর হোসাইন বহদ্দারের মালিকানাধীন দুটি ট্রলার এবং তাদের সঙ্গে থাকা মাতারবাড়ির আবছার মাঝি ও বাবুল মাঝির ট্রলারসহ আরও চার-পাঁচ টি ফিশিং ট্রলার শামসু মাঝির ট্রলার ধাওয়া করে আটক করে। এ সময় জেলেদের হিমঘরে আটক করে তালা মেরে ট্রলারটি ডুবিয়ে দেয়া হয়।’
মো. হায়াত দাবি করেন, ‘তিনিসহ ছয়জন আরেকটি ট্রলারে করে ফিরে আসেন।’
ওই ঘটনায় নিহত শওকত উল্লাহর ছোট ভাই আয়াতুল্লাহ জানান, ‘আমার ভাই আরো অনেকের সাথে ৭ এপ্রিল শামসু মাঝির ট্রলারে করে সাগরে মাছ ধরতে যান। ১১ তারিখে আমরা নিখোঁজের খবর পাই। আমি চট্টগ্রামে পড়াশুনা করি। ১৬ তারিখ এলাকায় আসি। কিন্তু কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারেনি। তারপরও তো ট্রলারে করে লাশ এলো।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণভাবে সাগরে মাছ ধরতে গেলে ৫-১০ দিন পর জেলেরা ফিরে আসে। এলাকার অনেকেই শামসু মাঝির ট্রলারে করে মাছ ধরতে যায়। যারা ফিরে আসতে পেরেছেন তারা আমাদের সঙ্গে এসে যোগাযোগ করেননি। আমাদের কোনো খবরও দেননি। আমরা একটি টেলিভিশনের খবর থেকে নিখোঁজের ঘটনা প্রথম জানতে পারি।’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘কারা হত্যা করল , কী কারণে হত্যা করল তা আমরা বুঝতে পারছিনা। পুলিশ তদন্ত করছে।
নিহত আরেকজন নুরুল কবিরের বাবা মোহাম্মদ হোসেন ডয়চে জানান, ‘আমার ছেলে আগেও শামসু মাঝির ট্রলারে করে মাছ ধরতে গিয়েছে। তার একাধিক ট্রলার আছে। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আমরা কক্সবাজার সদর থানায় মঙ্গলবার বিকেলে হত্যা মামলা করেছি। আমরা জানতে পেরেছি ডাকাতেরা তাদের ট্রলারের হিমঘরে হাত-পা বেধে তালা দিয়ে ট্রলার ডুবিয়ে দেয়। তাদের কাছে টাকা-পয়সা যা ছিলো তা লুট করে নিয়ে গেছে।
তিনি জানান, যে ১০ জনের লাশ পাওয়া গেছে তাদের ছয় জন মহেশখালির। বাকি চারজন চকোরিয়া এলাকার। ট্রলারের মালিক নিহত শামসুল আলমের বাড়ি মহেশখালী হোয়ানক ইউনিয়নের ছনখোলাপাড়ায়।
কক্সবাজার সদর থানা পুলিশ জানায়, এই ঘটনায় নিহত শামসু মাঝির স্ত্রী রোকেয়া বেগম বাদি হয়ে চারজনের নাম উল্লেখ করে মোট ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তাদের মধ্যে এজাহারভুক্ত বাইট্টা কামাল ও তার ট্রলারের চালক করিমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে কয়েকজন আছেন যারা এই প্রথম মাছ ধরতে সাগরে গিয়েছেন। আগে কখনো যাননি।
পুলিশ আরো জানায়, গুরা মিয়া নামের এক ব্যক্তির মালিকানাধীন একটি ট্রলার সাগরে ভাসমান থাকা ট্রলারটি নাজিরারটেক উপকূলে নিয়ে আসে। তাই অনেককে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটলো তা বের করার চেষ্টা চলছে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলামজানান, ‘যে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের রিমান্ডে আনা হবে। অন্য আসামিদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আর যে ছয় জন আগেই ফিরে এসেছেন তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আরো যে তিন জন নিখোঁজ বলা হচ্ছে তাদের অবস্থাও জানার চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, ‘হত্যাকান্ডের মোটিভ এখনো আমাদের কাছে পরিষ্কার না। আর পুরো ঘটনাটি আমরা জানার চেষ্টা করছি। আসামিদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে পুরো ঘটনা জানতে পারব বলে আশা করি।