এ বার আন্তর্জাতিক মা ধরিত্রী দিবস পালিত হয়েছে গত ২২ এপ্রিল। দিনটিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ নির্ধারণ করেছে—পৃথিবী নামের এ গ্রহ এবং এর বাসিন্দাদের কল্যাণে বৈশ্বিক সচেতনতা তৈরি করতে। মহাসাগর-মহাদেশ, বায়ু-পানি-মাটি ও জীববৈচিত্র্য সমন্বয়ে পৃথিবী নামের গ্রহে মানুষের বসবাস—‘মা ধরিত্রী’ শব্দযুগল ব্যবহার করে এ সবকিছুর আন্তঃসংযোগকে প্রকাশ করা হয়। ‘আমাদের গ্রহে বিনিয়োগ করুন’—এ প্রতিপাদ্য নিয়ে ২০২৩ সালে এ দিনটি পালিত হয়েছে। ২৫০ বছর আগে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছে, ভূতাত্ত্বিক সময়কাল বিবেচনায় এ অতি ক্ষুদ্র পর্বে মানুষ এ গ্রহের ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছে, এমনকি মহাকাশও বাদ যায়নি। মানুষ তার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ ছাড়াও আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস ও ক্ষমতা-শক্তিমত্তার জন্য সম্পদ আহরণ করতে গ্রহের ভূদৃশ্যকে বদলে দিচ্ছে। ভূউপরিস্থ মাটি-পলি অপসারণ, খাদ্যের জন্য বন বা অনাবাদি জমিকে কৃষি ভূমিতে রূপান্তর, নগরায়ণ ও যোগাযোগ উন্নয়ন, এমনকি পাহাড় কেটে; নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করে বাঁধ নির্মাণ, বেআইনি বন্য প্রাণী-বাণিজ্য; ঘটছে মাটি-পানি-বাতাসদূষণ ঘটেই চলেছে। মহাশূন্যে কৃত্রিম উপগ্রহের জঞ্জাল ইতিমধ্যেই সমস্যা তৈরি করছে, উদ্বেগের কারণ হয়েছে; এখন মানুষ যাচ্ছে মহাসাগরের গভীর তলদেশ হতে খনিজ আহরণ করতে। এ গ্রহে সকলেরই আছে বেঁচে থাকার অধিকার থাকলেও মানুষের কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত বুঝিয়ে দিচ্ছে এ পৃথিবী শুধুই তাদের, অন্যদের এখানে কোনো অধিকার নাই।
পৃথিবীর ৪৫০ কোটি বছর বয়সে বড় মাত্রার প্রাণের বিলুপ্তি ঘটেছে পাঁচ বার, সবগুলোই ঘটেছিল ভূতাত্ত্বিক অর্থাৎ প্রাকৃতিক কারণে। সবশেষটি ছিল ৬৫০ কোটি বছরের কিছু আগে, এতে বিশাল ভূতাত্ত্বিক কারণে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও বৈশ্বিক তাপমাত্রার সঙ্গে মহাসাগরের অম্লতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ৭৮ শতাংশ বিলুপ্তি ঘটে। ২৫ কোটি বছরের বেশি আগে অগ্ন্যুত্পাতের কারণে আরেকটি আকস্মিক ও বড় মাপের পরিবর্তন আসে, ফলে সাগরের ৯০ শতাংশ ও স্থলের ৭০ শতাংশ প্রাণের বিলুপ্তি ঘটে। এমন অগ্ন্যুত্পাত বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসারণ ঘটায়। সাম্প্রতিক একদল গবেষকের মতে, মানুষ এখন কার্বন নিঃসারণের তেমন অনুকৃতি করছে এবং তাদের আশঙ্কা সে সময়ের মতো আজকের দিনের মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মহাসাগরের খাবার শৃঙ্খলে প্রভাব ফেলবে। বর্তমানে আমরা নানা বৈশ্বিক বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করছি—বৈশ্বিক উঞ্চায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, মহাসাগরের বড় উতরাই, সমুদ্রজলের অম্লকরণ, জীববৈচিত্র্যের হ্রাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৌনঃপুনিকতা ইত্যাদি, তবে বাস্তবতা হলো এসব ঘটছে প্রাকৃতিক কারণে নয়, মূলত মানুষের কারণে। এখন দেখা যাক এসব ব্যাপারে মানুষের ভূমিকা কী।
শিল্প-বিপ্লব পরবর্তী সময় থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈশ্বিক উষ্ণায়নজনিত জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে, হিমালয়সহ অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সায়েন্স অ্যাডভান্সে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, ২০০২-২০১৬ সময়ে হিমালয় অঞ্চলে বরফ গলার গড় হার ১৯৭৫-২০০০ সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) ১৮ মে ২০২২-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সালে গ্রিনহাউজ গ্যাসের ঘনত্ব, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, সমুদ্র তাপমাত্রা ও অম্লকরণ নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। স্ক্রিপস্ ইনস্টিটিউট অব ওশানোগ্রাফির এক গবেষণামতে, ২০২২ সালে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বায়ুমণ্ডলের দৈনিক গড় কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের গাঢ়ত্ব ছিল প্রতি মিলিয়নে ৪২১.৩৭ শতাংশ; যা আগের বছরে একই সময়ে ছিল ৪১৮.৯৫ শতাংশ। গত ৪ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে ইউনিভার্স টুডেতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে, ১৯৯৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের মোট উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ দশমিক ১ সেন্টিমিটার। আরেক গবেষণায় দেখানো হচ্ছে, ২০২১ থেকে ২০২২ অর্থাৎ দুই বছরে বেড়েছে ০.২৭ সেন্টিমিটার ও প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে এ বৃদ্ধির হার হবে প্রতি বছরে ০.৬৬ সেন্টিমিটার।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বলি যেমন জীববৈচিত্র্য তেমন আবার জীববৈচিত্র্যই মানুষের অস্তিত্বের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এবং সর্বোপরি এ গ্রহের স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিল বলছে যে, গত ৫০ বছরে বৈশ্বিকভাবে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা ৬৯ শতাংশ কমেছে। বিশ্বব্যাপী ৭০ শতাংশ বাস্তুতন্ত্র অবক্ষয়ের মধ্যে আছে বলে মনে করছে জীববৈচিত্র্য ও ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস বিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় (আইপিবিইএস) বিজ্ঞান-নীতি প্ল্যাটফরম। এর ফলে ১ মিলিয়নের বেশি প্রজাতি বিলুপ্তির হুমকিতে আছে। ফ্রান্সের জাতীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্রের গবেষণা পরিচালক ক্যামিলে পারমেস্যান বলছেন একধরনের ফাংগাসের বৃদ্ধিতে ৯২ প্রজাতির উভচরের অন্তর্ধান ঘটেছে। অস্ট্রেলিয়ায় তাপপ্রবাহে এক দিনে ৪৫ হাজার বাদুড়ের এবং ২০২২ সালে ফ্রান্সের অস্বাভাবিক দাবদাহে ভূমধ্যসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় হাজার হাজার মাছ ও শামুকের মৃত্যু হয়। মানুষ দ্বারা আবাসস্থল ধ্বংস ও অবৈধ মৎস্য শিকারের কারণে গত ২০ বছরে বড় একধরনের কচ্ছপের সংখ্যায় ৯৫ শতাংশ পতন হয়েছে সুরিনামে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্র বর্তমানে মানবসৃষ্ট কার্বনের প্রায় ৫০ শতাংশ শোষণ করে নেয়—এক্ষেত্রে বন, জলাভূমি, ম্যানগ্রোভ বন এমনকি গভীর পানি প্রকৃত কার্বন সিংক, এদের অন্তর্ধান হলে নিঃসারণ বায়ুমণ্ডলে চলে যায়।
আমাদের বেঁচে থাকা ও সমৃদ্ধির জন্য দরকার বিশুদ্ধ পানি, নির্মল বায়ু, উর্বর মাটি, সজীব জীববৈচিত্র্য ও স্বাস্থ্যবান মহাসাগর। অন্যথায় এ শতকের শেষে মানুষের দুর্দশা বাড়বে, গ্রহ বিপর্যস্ত হবে। বৈশ্বিক এ সমস্যার সমাধান এককভাবে করা সম্ভব নয়, প্রয়োজন সকলের মানসিকতার পরিবর্তন ও সম্মিলিত প্রয়াস।