যুক্তরাষ্ট্র সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গতকাল সাক্ষাৎ করেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। ওয়াশিংটনের রিজ-কার্লটন হোটেলে তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছুটা স্বস্তির জন্য আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। আলাপকালে আইএমএফ এমডি করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অভিঘাতের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখার জন্য প্রশংসা করেছেন। তার মতে, ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কানেকটিভিটি ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে।
উল্লেখ্য, গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের ঋণ আবেদন অনুমোদন করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিচ্ছে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক এ সংস্থাটি। যার ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন আসছে ইসিএফ (Extended Credit Facility) এবং ইএফএফ (Extended Fund Facility) থেকে এবং বাকি ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন আসছে আরএসএফ (Resilience and Sustainability Facility) থেকে। বাংলাদেশ প্রথম এশীয় দেশ হিসেবে আরএসএফ থেকে ঋণ পেতে যাচ্ছে। মোট সাত কিস্তিতে এ টাকা আসছে। তবে এর সঙ্গে রয়েছে এক গাদা শর্তও।
গত এক দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক খাতে যে দৃশ্যমান উন্নতি করেছে, সেটি নিয়ে আলাদা করে বলবার কিছু নেই। কিন্তু পরপর দুই বছর কোভিড ও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধস না নামলেও অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন যে, কিছুটা স্বস্তির জন্য এই ঋণ নেওয়া হয়েছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক ধাক্কায় ৪১ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে ১১ বার টাকার মানের পতন ঘটে। দেখা দেয় ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বাণিজ্য ঘাটতি। ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ইমব্যালেন্স পরিলক্ষিত হয়। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসে রেমিট্যান্সের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। তবে গত ঈদুল ফিতরের পর থেকে আবার রেমিট্যান্সের গতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।
ইউরোপে যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের আরএমজি সেক্টর তথা তৈরি পোশাকশিল্প। এই খাতে সরকারি প্রণোদনা দেওয়ায় এই শিল্প ধকল কিছুটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। তার পরও ডলারসংকট রয়ে গেছে। এই সবকিছুর প্রভাবে বেড়ে গেছে মূল্যস্ফীতি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে হুহু করে। কারওয়ান বাজারের এক মাছ বিক্রেতার ভাষ্য, ‘আগে যেখানে ৭০-৮০ কেজি মাছ বিক্রি হতো, সেখানে এখন ৪০ কেজি হওয়াও কঠিন’। মূলত একধরনের অর্থনৈতিক অচলাবস্থার কারণে বাংলাদেশ সরকার আইএমএফের কাছে ঋণের আবেদন করে। কেননা, আমরা শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো বিপর্যয়ে পড়তে চাইনি। তার আগেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।
আইএমএফের শর্তের মধ্যে রয়েছে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো, ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও বাড়ানো, ঋণের খেলাপ কমিয়ে আনা, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, ভর্তুকি কমিয়ে আনা, আর্থিক কেলেঙ্কারি রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা বৃদ্ধি, সুদের হার ৯ শতাংশ বেঁধে না দেওয়া ইত্যাদি। এর মধ্যে অনেকগুলো শর্ত বাংলাদেশের ভালোর জন্যই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সিরডাপের পরিচালক (গবেষণা) ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আইএমএফ যে শর্তই দিক না কেন, ঐ শর্তগুলো নিয়ে দরকষাকষির মতো অবস্থানে বাংলাদেশের অর্থনীতি নেই। তাই বাংলাদেশকে ঋণ নিতেই হচ্ছে। তবে শর্তগুলো যেসব খারাপ তা কিন্তু নয়। অনেক শর্ত আছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ভালো। তবে কিছু কিছু শর্ত রয়েছে, যা মানা সরকারের জন্য বেশ কঠিন। আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়েই দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ, তেল ও গ্যাসের দাম। কেননা শর্ত মানা না হলে কিস্তির টাকা আটকে দেওয়া হবে বলেও জানিয়ে রেখেছে আইএমএফ। ফলে নির্বাচনের এই বছরে সরকারের সামনে পথটা বেশ দুর্গম। বহু অর্থনীতিবিদই বাংলাদেশের ঋণ নেওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তবে তাদের মত হলো, শুধু ঋণ নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। দেশের অর্থনীতিতে আমূল সংস্কার করতে হবে। অনেক অর্থনীতিবিদই মনে করেন যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন আর এই ঋণের শর্ত হতে পারে, সেক্ষেত্রে শাপে বর। যেমন—বাংলাদেশের মোট জিডিপির মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ আসে ট্যাক্স থেকে। সরকার চাইলে এক্ষেত্রে ধনীদের ওপর বাড়তি কর আরোপ করতে পারে। এতে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির যে শর্ত আইএমএফ রেখেছে, তা পূরণ হবে। সেই সঙ্গে সমাজে যেসব মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা প্রয়োজন, তাদের জন্য সেটির ব্যবস্থাও করা যাবে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ বৈদেশিক অন্যান্য ঋণ গ্রহণের কারণে বাংলাদেশের ডলারসংকট আপাতত দূর হবে, সেই সঙ্গে আমদানি ব্যয় মেটাতেও খুব একটা বেগ পেতে হবে না।